পার্থ চট্টোপাধ্যায় নাকি মর্মাহত। স্কুলশিক্ষিকাদের বিষয়ে তাঁহার মন্তব্যটির অপব্যাখ্যা হইয়াছে বলিয়া ফেসবুকে জানাইয়াছেন। ছোটবেলা হইতে তিনি যে শিক্ষা পাইয়াছেন, তাহার কথাও উল্লেখ করিয়াছেন মন্ত্রিবর। আপাতত একটি ভিন্ন শিক্ষার প্রসঙ্গে দুই-এক কথা বলা প্রয়োজন। পুরুষতন্ত্রের শিক্ষা। সমাজের শিরা-উপশিরায় যে ‘শিক্ষা’র স্রোত বহমান। পুরুষতন্ত্র নারীকে দেখে পুরুষের তুলনায়— যেখানে পুরুষের সহিত তাহার অমিল, সেই বিন্দুগুলিকে পুরুষতন্ত্র ‘অস্বাভাবিক’ হিসাবে দাগাইয়া দেয়।
এ হেন অমিলের সংখ্যা প্রচুর। পুরুষতন্ত্রের চক্ষে তাহার কোনওটি হাস্যকর, কোনওটি ঘৃণ্য, কোনওটি আবার নিতান্ত গোপনীয়। এবং, ক্ষমতা যে হেতু সর্বদাই পুরুষতন্ত্রের হাতে— এমনকি, ক্ষমতার শীর্ষে কোনও নারী অধিষ্ঠিত হইলেও— ফলে, নারীর এই ‘অস্বাভাবিকতা’গুলিকে আশ্রয় দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা করিবার কথা ভাবিয়া উঠা আর সম্ভব হয় না। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীও নিশ্চয় জানেন, এই রাজ্যে বহু স্কুলশিক্ষিকাকেই প্রত্যহ বেশ কয়েক ঘণ্টা ট্রেন-বাস-ভ্যান-নৌকা-পদব্রজে সফর করিয়া তবে স্কুলে পৌঁছাইতে হয়। সেই স্কুলে কয়েক ঘণ্টা কাটাইবার পর ফের এই যাত্রাপথ। শিক্ষামন্ত্রী হয়তো জানেন, হয়তো জানেন না, কিন্তু এই দীর্ঘ যাত্রাপথে বহু শিক্ষিকাই কোনও শৌচাগারের দর্শন পান না। এমন স্কুলও আছে, যেখানে মহিলাদের জন্য কোনও শৌচাগার নাই। যেখানে আছে, সেখানেও তাহা কার্যত ব্যবহারের অযোগ্য। ফলে, মনের জোরে শারীরিক প্রয়োজন ভুলিয়া থাকা অনেকেরই রোজনামচার অঙ্গ। এর মধ্যে ঋতুস্রাবের দিনগুলিও পড়ে। তাহার পর, স্কুলশিক্ষিকারা যে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন নামক ব্যাধির সহজতম শিকার হইবেন, তাহাতে অবাক হইবার বিন্দুমাত্র কারণ নাই। হাস্যরসের সন্ধান পাইবার কারণ আরওই নাই।
ভারতের সর্বত্রই পুরুষতন্ত্রের অক্ষয় আসন। ‘সংস্কৃতির পীঠস্থান’, ‘প্রগতিশীল’ পশ্চিমবঙ্গ যেন আরও দুর্জয় ঘাঁটি। দিল্লির মেট্রোয় কার্যত প্রতিটি স্টেশনে শৌচাগার আছে। দেশের সব বড় শহরের রাস্তাতেই ব্যবহারযোগ্য শৌচাগার আছে। পশ্চিমবঙ্গে, কলিকাতায় নাই। এই না থাকা যে অসহ্য অন্যায়, শাসক বা বিরোধী, কোনও গোত্রের রাজনীতির মুখেই সেই কথাটি কখনও শোনা যায় নাই। তাহার কারণটি সহজ। শারীরিক ক্রিয়া মিটাইতে নারীর ন্যায় পুরুষের আড়াল প্রয়োজন হয় না। শৌচাগার না থাকিলে পুরুষ বিলক্ষণ রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া পড়িতে পারে। ফলে, শৌচাগারের প্রয়োজনটি পুরুষতন্ত্রের চক্ষে যথেষ্ট জরুরি প্রতিপন্ন হয় না। স্তন্যপান করাইবার জন্য বিশেষ কক্ষের কথা তো আরও সুদূর। কিছু কাল পূর্বে কলিকাতার এক শপিং মলে স্তন্যপান করাইবার কক্ষের অভাবের প্রসঙ্গে জানা যায়, গোটা শহরে কার্যত কোথাও সেই ব্যবস্থা নাই। স্তন্যপান করাইবার কাজটি একান্ত ভাবেই মহিলাদের। ফলে, পুরুষতন্ত্র ভাবিতেই পারে না, বাড়ির বাহিরেও সেই প্রয়োজন হইতে পারে, এবং প্রয়োজনটি মিটাইবার ব্যবস্থা করা বিধেয়। বরং, এই গোত্রের প্রয়োজনের কথা শুনিলে অনেকেরই হাসি পায়। কেহ মুখ টিপিয়া হাসেন, কেহ প্রকাশ্য সমাবেশে। এই দাবিগুলির রাজনৈতিক প্রশ্ন হইয়া উঠা সম্ভবত অন্য কোনও সাধনার ফল। তবে, নেতারা ভোট চাহিতে আসিলে মহিলারা দাবিগুলি পেশ করিয়া দেখিতে পারেন। ভোটের তাগিদে অনেক অর্গলই শিথিল হয়।