কমলা হ্যারিস (বাঁ দিকে), ডোনাল্ড ট্রাম্প (ডান দিকে)।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এখন সমগ্র বিশ্বের বড় সংবাদ। কেন এত বাড়াবাড়ি এই একটি দেশের নির্বাচন নিয়ে, সে প্রশ্ন, সংশয়, বিরক্তি অনেকেরই মনে। বাড়াবাড়ির একটা কারণ অবশ্যই অর্থনৈতিক। ঠিক, কবেই চলে গিয়েছে ঠান্ডা যুদ্ধের দিন, দ্বিমেরু দূরস্থান, এখনকার বিশ্বে তেমন কোনও ‘মেরু’ আছে কি না, এও গভীর আলোচনার বিষয়। তবু আমেরিকার অর্থনৈতিক ক্ষমতা যে এখনও কতখানি, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠনগুলির দিকে তাকালেই তা বোঝা জলবৎ সহজ। দ্বিতীয় কারণটি সামরিক, প্যালেস্টাইন ইজ়রায়েল সঙ্কট তার সাক্ষাৎ প্রমাণ। এক বছর কেন, ইজ়রায়েল তার হাজার অস্ত্রসম্ভার নিয়েও কয়েক মাসের বেশি এই যুদ্ধ চালাতে পারত না যদি না তার পিছনে থাকত ক্যাপিটল হিল-এর আশীর্বাদ। এই সবের উৎসে যা আছে, তা হল তৃতীয় কারণ: এখনও ইউরোপের ‘উন্নত’ দেশগুলি আমেরিকার কথা মেনেই পা তোলে পা ফেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বের এই অনপনেয় ওয়াশিংটন-নির্ভরতা একুশ শতকের তৃতীয় দশকেও সত্য ও স্পষ্ট। ফলত ডোনাল্ড ট্রাম্প না কমলা হ্যারিস, এই চর্চা স্বাভাবিক ভাবেই পৃথিবীর সর্বত্র সংবাদমাধ্যমের প্রধান হেডলাইনগুলির দখল নিচ্ছে গত কয়েক দিন যাবৎ।
লক্ষণীয়, ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি চয়নেই হোক, অভিবাসী বা সংখ্যালঘু অধিকারের বয়ানেই হোক, কিংবা জনগণের করের টাকা দিয়ে ইজ়রায়েলকে সামরিক সাহায্য দানের প্রতিবাদেই হোক, এ বারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটা কেন্দ্রীয় ধুয়ো হল নাগরিকের ‘ফ্রিডম’ বা স্বাধীনতা, যে শব্দের অধিকার চাইছে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দুই দলই। দু’টি মাত্র দল, দু’টি দলের নামেই স্বাধীনতার সংজ্ঞাটি গভীরপ্রবিষ্ট— সেই অর্থে ‘ফ্রিডম’ হল আমেরিকার রাজনৈতিক পটচিত্রের প্রধানতম ‘আয়রনি’, বিদ্রুপ বা ব্যাজশব্দ। ডেমোক্র্যাটরা ওই শব্দের ভাগ চান অনায়াসেই, কেননা গণতন্ত্র কথাটির মধ্যে প্রথমেই আছে স্বাধীনতা। আমেরিকার প্রবাদপুরুষ তো গণতন্ত্রের সর্বজগৎমান্য সংজ্ঞাটি দিয়েই গিয়েছেন, ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, [অ্যান্ড] ফর দ্য পিপল’ (এব্রাহাম লিঙ্কন)। কিন্তু রিপাবলিক কথার মধ্যেও কি স্বাধীনতারই প্রথম মান্যতা নেই? রিপাবলিক বা সাধারণতন্ত্রের অর্থ শাসন সংগঠন বা নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার ব্যবহার। সব মানুষ যেন নিজের স্বাধীন অধিকারের প্রতিফলন ঘটাতে পারেন শাসক নির্বাচন প্রক্রিয়ায়, এটাই তার মূলনীতি। আর এক জনের কথা এই প্রসঙ্গে বলতে হয়, আমেরিকার গণতন্ত্রের আর এক পথিকৃৎ জর্জ ওয়াশিংটন। প্রেসিডেন্ট হয়ে প্রথম বক্তৃতাতেই তিনি বলেছিলেন, ‘আমেরিকান ডেমোক্র্যাসি কনস্টিটিউটস আ গ্রেট এক্সপেরিমেন্ট’, কেননা সরকারের এই ‘রিপাবলিকান ফর্ম’ মানুষের হাতে দিয়েছে চরম ক্ষমতা, মানুষ কী ভাবে তার মঙ্গলের জন্য সেই ক্ষমতা ব্যবহার করবে, সে তার নিজের বিবেচনা। নিজেরই বিবেচনা, এবং সে বিবেচনা সব সময় শুভ না-ই হতে পারে। বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাইতেন সে কথা। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিয়ে আমেরিকা অষ্টাদশ শতকের সপ্তম দশকের শেষে ডেমোক্র্যাসি ও রিপাবলিকান দুই মহান আদর্শের ধ্বজা তুলে ধরল ঠিকই, কিন্তু স্মরণীয় ফ্র্যাঙ্কলিনের সেই একবাক্যিক শ্লেষ, আমেরিকা একটি ‘রিপাবলিক, ইফ ইউ ক্যান কিপ ইট!’
রাষ্ট্রনীতিবিদ এবং রাজনীতিকরা বুঝিয়ে বলেছেন, গণতন্ত্র, সাধারণতন্ত্র ইত্যাদির মধ্যে যে স্বাধীনতা নীতির ব্যবহার আছে, তার সাফল্য আসলে নির্ভর করে সংখ্যালঘুকে কী ভাবে দেখা হচ্ছে তার উপর। গণতন্ত্র মানেই মানুষের স্বাধীন ভোট, আর তা ত্বরিত পরিণত হতে পারে সংখ্যাগুরুর দমনবাদে, যদি না সংখ্যালঘুর বিষয়ে মানবিক সংবেদনশীলতা দেখানো যায়। সেই অর্থে বিশ্বের অধিকাংশ গণতন্ত্রই, আমেরিকা-সহ, আজ ব্যর্থ। আগামী কয়েক দিনে স্থির হবে কে সে দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন, কিন্তু যিনিই আসুন, তাঁকে মনে রাখতে হবে, গত কয়েক দশক ধরে, বিশেষত ৯/১১ পরবর্তী সময়কালে, অভিবাসী, অশ্বেতাঙ্গ, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, এবং দেশের বাইরে অন্যান্য তুলনায় পশ্চাৎপদ সমাজ (যেমন প্যালেস্টাইন), এদের সকলের প্রতি সংবেদনশীলতা রাখতে দুই দলই প্রবল ভাবে ব্যর্থ। বিশ্বের গৌরবময় প্রাচীন গণতন্ত্রের দু’টি যুযুধান দলই আদর্শগত ভাবে সম্পূর্ণ চ্যুত হয়েছে ‘স্বাধীনতা’র নীতি থেকে। এই বিচ্যুতি কেবল বিপজ্জনক নয়, অক্ষমার্হ। যে দেশের শক্তি সর্বাধিক, তার বিচ্যুতির দামও সর্বোচ্চ। কেবল সেই দেশ একা নয়, বিশ্বের অপরাপর দেশও তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।