কেন্দ্রের বঞ্চনা নিয়ে রাজ্যের নালিশ অন্তহীন, অথচ বরাদ্দ টাকা রাজ্যে যথাসময়ে খরচ হচ্ছে না। সংবাদে প্রকাশ, এ জন্য স্বাস্থ্যখাতে প্রায় চারশো কোটি টাকার কেন্দ্রীয় বরাদ্দ হারাতে পারে রাজ্য, যা জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের খাতে গত অর্থবর্ষের মোট বরাদ্দের প্রায় চল্লিশ শতাংশ। এর ফলে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ওই প্রকল্পে কেন্দ্রের বরাদ্দ অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে— কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত যে, রাজ্যগুলি বরাদ্দ অর্থের অন্তত তিন-চতুর্থাংশ খরচ না করতে পারলে পরের বছর আর টাকা দেওয়া হবে না। প্রায় একই পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পের ক্ষেত্রেও। চলতি অর্থবর্ষের জন্য রাজ্যের প্রস্তাবিত শ্রম বাজেট অনুমোদন করেনি কেন্দ্র। সম্প্রতি দশ জন তৃণমূল সাংসদের একটি দল কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহের কাছে এ নিয়ে দরবার করেছেন। কিন্তু এ কি সাংসদদের কাজ? খরচ করা ও হিসাব দাখিলের কাজ আধিকারিকদের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই নানা সভায় কেন্দ্রের সাড়ে ছ’হাজার কোটি টাকা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিক অভিসন্ধি বলে আখ্যা দিয়েছেন। রাজ্যের সাংসদদের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে সম্ভবত সেই বার্তাই আরও স্পষ্ট করা হল। কিন্তু মূল প্রশ্নটি হল, এনআরইজিএ প্রকল্পের গত অর্থবর্ষের হিসাব কি দাখিল করেছিল রাজ্য? কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিজেপির দাবি, রাজ্য সরকার পরিকল্পনা-বহির্ভূত ভাবে বিপুল খরচ করেছে, তার হিসাব দাখিল করেনি। এখন জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনে একই অভিযোগ উঠছে। সংবাদে প্রকাশ, সাত দিনের মধ্যে বরাদ্দের অন্তত পঁচাত্তর শতাংশ হিসাব দাখিলের চেষ্টা করছেন আধিকারিকরা। না হলে কেন্দ্রের বরাদ্দ মিলবে না।
যদি বা আধিকারিকরা এত অল্প সময়ে এতগুলি টাকা খরচের বিধিবদ্ধ হিসাব দেখাতে পারেন, তা হলেও কয়েকটি প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রথমত, কেন যথাসময়ে যথাযথ হিসাব দাখিল করা হয়নি? স্বাস্থ্যকর্তারা অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন, এই ব্যাখ্যা বড়ই দুর্বল। সরকারি কর্মীদের নিয়মিত কাজের একটি প্রধান অঙ্গ হল হিসাব দাখিল করা। কাজের সঙ্গে সঙ্গে হিসাব দাখিল না করলে ভুয়ো খরচ এবং কাল্পনিক হিসাবের সন্দেহ আরও জোরদার হতে বাধ্য। দ্বিতীয়ত, জাতীয় স্বাস্থ্য মিশন প্রকল্পে কেন্দ্রের বরাদ্দের সঙ্গে রাজ্যের বরাদ্দও থাকে। অনুপাত যথাক্রমে ষাট ও চল্লিশ শতাংশ। স্বাস্থ্য মিশনের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য যথাক্রমে ১৬৪৩ কোটি টাকা এবং ১০৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল ২০২১-২২ সালের জন্য। রাজ্য যে টাকা বরাদ্দ দেখিয়েছে, তারই বা কতটা খরচ হয়েছে? এই সম্মিলিত অর্থের কতটা জনস্বার্থে ব্যবহার হয়েছে? বহু বকেয়া পড়ে রয়েছে— আশাকর্মীরা উৎসাহভাতা পাননি, গর্ভবতী মায়েদের অনুদান দেওয়া হয়নি, বহু প্রয়োজনীয় ওষুধ ও সরঞ্জাম কেনা হয়নি। এর ফলে মানবসম্পদের যে ক্ষতি, তার হিসাব করবে কে? টাকা আছে, অথচ সরকারি কর্তারা তা নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট কারণে ব্যয় করছেন না— এ কেবল প্রশাসনের দুর্বলতা নয়, রাজ্যবাসীর সঙ্গে প্রতারণা। রাজনীতির মারপ্যাঁচে তাকে আড়াল করা যাবে না।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ গত পাঁচ দশক ধরে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী দলকেই রাজ্যে শাসকের আসনে বসিয়ে আসছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহেও কী করে রাজ্য পরিচালনা এবং উন্নয়নের উপযোগী টাকা আদায় করা যায়, তার কৌশল এ রাজ্যের সরকারি আধিকারিকদের অজানা নয়। প্রশ্ন হল, তাঁরা কি তাঁদের কর্তব্য পালনের স্বাধীনতা পাচ্ছেন? না কি প্রভাবশালীদের বাধায় কার্যত পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে রয়েছেন? সরকারি কর্মী যখন নিষ্ক্রিয়তাকে নিরাপদ মনে করেন, তখনই দেশের দুঃসময়। কেন্দ্রীয় বরাদ্দ হারানো সেই দুর্দিনের একটি লক্ষণমাত্র।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।