— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
একটি রাজ্যে বিদ্যালয় স্তরে পড়াশোনা যে কত সমস্যাসঙ্কুল হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গ দিন দিন তার এক অতীব দুর্ভাগ্যজনক উদাহরণ হয়ে উঠছে। এখানে সরকার নিয়ন্ত্রিত স্কুলে রোজকার পড়াশোনা নিয়েই হরেক সমস্যা: শিক্ষকের অভাব, পড়ুয়ার অভাব, মিড-ডে মিল নিয়ে অব্যবস্থা, অযাচিত ও প্রলম্বিত ছুটি, ভোট-সহ রাষ্ট্রের যে কোনও কাজে শিক্ষকদের ও স্কুল পরিকাঠামোর ‘দখল’ নেওয়া— এবং প্রাইভেট টিউশন। শেষোক্তটি যেন এক দুর্গ্রহ, স্কুলশিক্ষাকে কিছুতেই ছাড়তে চায় না, এমনকি আদালতের হস্তক্ষেপ ও নির্দেশেও না। গত বছর থেকে সম্প্রতিকাল পর্যন্ত কলকাতা হাই কোর্ট নানা সময়ে একাধিক বার বলেছে, সরকার নিয়ন্ত্রিত স্কুলগুলির শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করতে হবে। তবু তা বন্ধ হয়নি। গত সপ্তাহেই আবারও আদালত স্কুল শিক্ষা দফতরকে নির্দেশ দিল মধ্যশিক্ষা পর্ষদ ও জেলা স্কুল পরিদর্শকদের নিয়ে এ বিষয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ করার, এ বার সময় আট সপ্তাহ।
এ ধরনের সময়সীমা আগেও দেওয়া হয়েছে। পর্ষদের নির্দেশানুসারে বিভিন্ন সরকার-নিয়ন্ত্রিত স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের থেকে মুচলেকাও আদায় হয়েছে এই মর্মে যে, তাঁদের স্কুলের শিক্ষকেরা প্রাইভেট টিউশন করেন না। তবু যে প্রাইভেট টিউশন নিয়ে আদালতে রাজ্যের গৃহশিক্ষক সমিতির ক্রমাগত অভিযোগ বা মামলা হয়েই চলেছে তা-ই প্রমাণ করে, সরকারি স্কুলশিক্ষকদের এক বৃহদংশ প্রাইভেট টিউশন থামাননি। আসলে তাঁরা সুযোগ নিচ্ছেন— প্রাইভেট টিউশন সংক্রান্ত আইনের অনুপস্থিতি, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নজরদারির পরিকাঠামোর অভাবের, এবং সর্বোপরি ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক মহলের ‘সমর্থন’-এর। এই সমর্থনও পরিস্থিতি-উদ্ভূত: সরকার-নিয়ন্ত্রিত স্কুলে রোজকার সহজ স্বাভাবিক পড়াশোনার কাজটিই এত দূর পর্যন্ত ব্যাহত হচ্ছে যে অভিভাবকেরা ধরেই নিয়েছেন পড়াশোনা যা হবে তা স্কুলে নয়, স্কুলের বাইরে প্রাইভেট টিউশনে— এবং স্বাভাবিক ভাবেই স্কুলশিক্ষকদের বাড়িই হয়ে উঠছে অমোঘ গন্তব্য। সরকার-নিয়ন্ত্রিত স্কুলশিক্ষকদের এ এক ধরনের আর্থ-মনস্তাত্ত্বিক শোষণ— অনন্যোপায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবক মহল অজানতে বা জেনেবুঝেই যার শিকার হচ্ছে।
প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করতে আদালত ও শিক্ষা দফতরকে আর কোন কঠোরতর পদক্ষেপ করতে হবে, সেই আলোচনার পাশাপাশি বারংবার তোলা দরকার গোড়ার প্রশ্নটি: কেন আদৌ প্রাইভেট টিউশন দরকার? শিক্ষকদের আর যত কাজই থাকুক, শিক্ষা-বহির্ভূত অতিরিক্ত যত দায়িত্বই তাঁদের উপর এসে পড়ুক, তাঁদের প্রথম ও প্রধানতম কাজটি হল শিক্ষকতা, রোজ নিয়ম করে ও মন দিয়ে পড়ানো, এইটুকু কেন তাঁরা করতে পারবেন না? দুর্নীতির ঘূর্ণিতে এমনিতেই এ রাজ্যের স্কুলশিক্ষা বেহাল, শিক্ষক নিয়োগ স্তব্ধ, গরমের ছুটি বছর বছর দীর্ঘতর হওয়া এক প্রকার নিয়মে পর্যবসিত— শিক্ষাবর্ষের ক্যালেন্ডারে পড়াশোনার জন্য রাখা দিনসংখ্যা খাতায় কলমে না হলেও বাস্তবে ক্রমশ কমছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারি স্কুলশিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন আসলে শিক্ষাক্ষেত্রে মুশকিল আসান না কি ঝোপ বুঝে মোক্ষম কোপ— সেই প্রশ্নটি খোলাখুলি করা দরকার। পড়ুয়াদের শিক্ষার ‘অধিকার’ কি এই শিক্ষকদের হাতে ক্রমে এক প্রহসনে পরিণত হচ্ছে না?