Government of West Bengal

আনুগত্যের শর্ত

কেন রাজকোষ উজাড় করিয়া ক্লাবগুলিকে অনুদান দেওয়া হইয়াছিল, সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ কম— তাহা ছিল সরকারি অর্থে আনুগত্য আদায়ের অলজ্জ পন্থা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২১ ০৫:২৯
Share:

প্রতীকী ছবি।

অর্থ বনাম আনুগত্যের দ্বৈরথে এই মুহূর্তে রাজ্যের ক্লাবগুলি জেরবার, বলিলে ভুল হইবে কি? নির্বাচনের আবহে দৃশ্যত পরিষ্কার, তাহারা দ্বিধাবিভক্ত হইয়া গিয়াছে। ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসিবার পর হইতেই তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত সরকার ক্লাবগুলিকে কয়েক দফায় কয়েক লক্ষ টাকা অনুদান দিয়াছিল। বলা হইয়াছিল, এই টাকা ক্লাবগুলির নিজস্ব উন্নয়নের কাজে ব্যবহারের জন্য। পরিকাঠামোগত উন্নয়ন কিছু হইয়াছে বটে, কিন্তু অর্থ বিস্তর অনর্থও ডাকিয়া আনিয়াছে। হিসাবে গরমিল, অর্থ নয়ছয়, চালচুলা-ঠিকানাহীন ক্লাবেরও অর্থপ্রাপ্তি, স্থানীয় নেতা বা ক্লাবকর্তার টাকা আত্মসাৎ— সকল অভিযোগই উঠিয়াছে। এবং তাহা অবান্তরও নহে। কেন রাজকোষ উজাড় করিয়া ক্লাবগুলিকে অনুদান দেওয়া হইয়াছিল, সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ কম— তাহা ছিল সরকারি অর্থে আনুগত্য আদায়ের অলজ্জ পন্থা। ইদানীং কালে অর্থদান নাই, ভোট-আবহে বহু ক্লাবে বে-সুর বাজিতেছে। তাহাদের বক্তব্য, যে দলের অনুদান লইয়াছি, তাহাকেই ভোট দিবার বাধ্যবাধকতা নাই। অনুদান ফুরাইয়াছে, কৃতজ্ঞতাও।

Advertisement

দান ও প্রতিদান, তোষণ ও আনুগত্যের এই সমীকরণ সাম্প্রতিক কালে জটিল হইয়া উঠিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের সমাজ বরাবরই রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত, এবং সাদা-কালো, ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিত জাতীয় বিপ্রতীপ ধারণায় দ্বিধাবিভক্ত। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই সকল দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করিয়া সমাজে একটি সর্বজনীন ও মানবিক পরিসরের অস্তিত্ব ছিল। ক্লাবগুলি ছিল সেই পরিসরের ধাত্রীভূমি। রক্তদান শিবির হইতে বিনোদন-অনুষ্ঠান বা দুর্গাপূজার আয়োজনে দলীয় রাজনীতি ছিল না; মৃতের শ্মশানযাত্রায় কাঁধ দিতে মানুষটি বিরোধী দলের সমর্থক ছিলেন কি না, সেই প্রশ্ন সচরাচর ছায়া ফেলিত না। রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠিয়া, একত্রে কাজ করিবার ঔদার্য ও সামর্থ্য দুই-ই ছিল। দুর্ভাগ্যজনক, অনুদানের রাজনীতি সেই পরিসরটিকেও মুছিয়া দিল। বহু ক্লাব বিয়েবাড়ি বা জিম গড়িয়া নিজস্ব স্থায়ী রোজগারের পথ প্রশস্ত করিল; ক্লাবকর্তা ও নেতার দুর্নীতিতে কোথাও অনুদানের টাকা ক্লাবেই পৌঁছাইল না; নিয়মিত সামাজিক কাজ করিয়াও অনুদানের প্রকৃত দাবিদার বহু ক্লাব অস্পৃষ্ট থাকিয়া গেল। আজ আনুগত্যের প্রশ্নে অভিমানী বা বিদ্রোহী তাহারা মুখ ফিরাইবে, আশ্চর্য কী!

তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, অনুদান দিয়াও ক্লাবের তরফে সমর্থন বা ভোটব্যাঙ্ক নিশ্চিত হইতেছে না। একদা কাহারও হাতে কিছু সুযোগসুবিধা ধরাইয়া দেওয়া হইয়াছিল বলিয়াই তিনি চির অনুগত থাকিবেন, রাজনৈতিক আনুগত্যের এই মৌল ধারণা আর খাটিতেছে না। স্পষ্টতই, আনুগত্য আদৌ অতীতচারী নহে, ঘোর বর্তমানবাদী এবং ভবিষ্যৎমুখী। অতীতে সুবিধা মিলিয়াছে তো কী, তাহাও এখন অতীত। দল বা সরকার বর্তমানে কী সুযোগসুবিধা দিতেছে, ভবিষ্যতেও তাহার দিবার সম্ভাবনা বা সামর্থ্য কতখানি থাকিবে, তাহার নিক্তিতেই একটি গোষ্ঠী বা কৌমের বাধ্যতার পরিমাপ নির্ধারিত হইতেছে। আনুগত্যের এই ধারণায় কেবল রাষ্ট্রবিজ্ঞান নহে, উঁকি দিতেছে অর্থনীতির দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক, দাতার ভবিষ্যৎ-সামর্থ্যের সম্ভাব্যতার নিরিখে বর্তমানে সুরে বা বেসুরে বাজিবার আচরণ।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement