গত কয়েক বৎসরে পশ্চিমবঙ্গ যে উন্নয়ন-অর্থনীতির একটি অচর্চিত পথে হাঁটিতেছে, এত দিনে তাহা স্পষ্ট। সেই পথটির মূল সুর হইল, বাজার প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর না করিয়া সরকার সরাসরি নাগরিকের হাতে অর্থ ও পরিষেবার জোগান দিবে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থসাহায্যই হউক বা লক্ষ্মীর ভান্ডার বা স্বাস্থ্যসাথীর ন্যায় প্রকল্প, উন্নয়ন অর্থনীতির এই বাঁকবদল লইয়া বিস্তর চর্চা হইয়াছে। কিন্তু, বিকল্পের পরিশ্রম প্রচুর— নাগরিকের হাতে যদি সরাসরি অর্থ, পণ্য বা পরিষেবা পৌঁছাইয়া দিতে হয়, তবে তাহার মৌলিক শর্ত হইল, সরকারের হাতে সেই ব্যয়ভার বহন করিবার মতো যথেষ্ট টাকার সংস্থান থাকিতে হইবে। পশ্চিমবঙ্গে সরকার যে উন্নয়ন কর্মসূচি ফাঁদিয়া বসিয়াছে, কোনও রাজ্যের সরকারের পক্ষেই তাহার ব্যয়ভার সম্পূর্ণত বহন করা সম্ভব কি না, সেই প্রশ্নটি উড়াইয়া দিবার নহে। আরও গুরুতর বিবেচনা হইল, আর্থিক স্বাস্থ্যের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ দেশের অগ্রগণ্য রাজ্যগুলির তালিকাভুক্ত নহে। ফলে, উদ্দেশ্য যতই মহৎ হউক, উন্নয়নের এই বিকল্প পথ তাত্ত্বিকদের নিকট যতই গ্রহণযোগ্য হউক না কেন, তাহার ব্যবহারিক সাফল্য নির্ভর করিতেছে টাকার সংস্থান করিতে পারিবার উপর। সে বাবদ সংবাদ এখনও আশাপ্রদ নহে। সম্প্রতি সংবাদে প্রকাশ, সরকারি প্রকল্পে টাকার টানাটানি চলিতেছে। ফলে, বিভিন্ন দফতরকে অনেক নূতন পরিকল্পনা স্থগিত রাখিতে হইতেছে। সংবাদটি দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু অপ্রত্যাশিত নহে। অর্থশাস্ত্রে আয়-ব্যয়ের হিসাব না মিলাইয়া পালাইবার পথ নাই।
অর্থাভাবের একটি বড় কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের অসহযোগিতা। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষতিপূরণের টাকাই হউক, বা জিএসটি বাবদ রাজ্যের প্রাপ্য অর্থই হউক, কেন্দ্রের হাত হইতে টাকা গলে না। ফলে, টান পড়ে রাজ্যের রাজকোষে। পিএম-কিসান প্রকল্পের ক্ষেত্রেও যেমন রাজ্য পরিসংখ্যান দিয়া জানাইতেছে যে, কত কৃষক তাঁহাদের প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত হইলেন। অন্য দিকে, ইহাও সত্য যে, বিভিন্ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার কেন্দ্রের টাকা ফিরাইয়া দিয়াছে। এই সিদ্ধান্ত যুক্তিহীন, কারণ রাজ্য বা কেন্দ্র, কোনও সরকারই টাকার মালিক নহে। টাকা জনগণের— যে সরকারের রাজকোষ হইতেই আসুক না কেন, সেই টাকায় জনগণেরই অধিকার। রাজনৈতিক বিবাদের আঁচ উন্নয়নের আঙিনায় পড়িতে দিলে যে বিপত্তি হইবার, পশ্চিমবঙ্গে তাহাই হইয়াছে— যত কাজ করিবার ইচ্ছা, সরকারের হাতে তত টাকা নাই। আশা করা যায়, নিজের ভ্রান্তি হইতে শিক্ষা লইবে রাজ্য সরকার। টাকা যে কেন্দ্রের নহে, মানুষের, এবং সেই টাকায় মানুষের অধিকার অনস্বীকার্য— এই কথাটি ভুলিবে না।
তবে তাহাতেও রাজ্যের মূল সমস্যাটির সমাধান হইবে না। এই রাজ্যে বৃহৎ শিল্প নাই, এবং তাহা গঠনে রাজনৈতিক শ্রেণির আগ্রহও নাই— ইহাই পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম ট্র্যাজেডি। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী শিল্পায়ন বিষয়ে কিছু ইতিবাচক কথা বলিয়াছেন, কিন্তু না আঁচাইলে যে বিশ্বাস নাই, এই কথাটি রাজ্যবাসী অভিজ্ঞতায় বিলক্ষণ জানেন। বৃহৎ শিল্প প্রয়োজন, কারণ রাজ্য সরকার উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাজারের গুরুত্বকে অস্বীকার করিতে চাহিলেও, তাহা সম্ভব নহে— উন্নয়ন-ভাবনায় বাজারকে একটি মুখ্য ভূমিকা দিতেই হইবে। বৃহৎ শিল্প যে শুধু কর্মসংস্থান করিবে, তাহাই নহে— রাজ্যের অর্থব্যবস্থার মাপ আড়ে-বহরে বৃদ্ধি পাইবার অর্থ, রাজস্ব আদায় বাবদ রাজ্যের রাজকোষে অধিকতর অর্থ আসিবে, ফলে উন্নয়ন-খাতে খরচ করিবার সুযোগও সরকারের বাড়িবে। প্রশ্ন হইল, শিল্পমেধ যজ্ঞের মাধ্যমে যে রাজ্যে রাজনীতির আবাহন হয়, সেই রাজ্য কি উন্নয়নের স্বার্থে শিল্পের অপরিহার্যতা স্বীকার করিতে পারিবে? পশ্চিমবঙ্গে কি শিল্পায়ন সম্ভব হইবে? এই প্রশ্নের উত্তরের উপরই রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল।