Verbal Spat

কথার কথা?

তথাকথিত লিঙ্গসাম্যের রাষ্ট্রেই যখন এই, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, ভারতের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় কুবাক্যের বিস্তার কত বহুল ও ‘স্বাভাবিক’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০২২ ০৫:১২
Share:

শারীরিক নিগ্রহ, গায়ে হাত তোলা বা চড়চাপড়েই যে শুধু অপমানের অনুভব তা নয়, কুবাক্যও একই অনুভূতির অনুঘটক— বলছে বিজ্ঞান। নেদারল্যান্ডসের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গিয়েছে, হিংসাত্মক শব্দ শোনামাত্র মানবমস্তিষ্কে যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে তা ক্ষুদ্র চপেটাঘাতের সমান; অপমানকর, প্রশংসাসূচক ও নিরপেক্ষ শব্দরাজি একই সঙ্গে উচ্চারিত হলে মস্তিষ্কে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি— সেকেন্ডেরও এক-চতুর্থাংশ সময়ে প্রতিক্রিয়া ঘটছে কুবাক্য শ্রবণে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যে মানুষটিকে খারাপ কথা বলা হচ্ছে শুধু তাঁরই যে এই প্রতিক্রিয়া ঘটছে তা নয়, তা শুনছেন এমন অন্য মানুষের মস্তিষ্কেও একই অনুভূতি হচ্ছে। ঠিক কেন বা কী ভাবে কুশব্দের শ্রবণ মস্তিষ্কে এমন অভিঘাত তৈরি করছে সেই সন্ধান এখনও জারি, তবে এই বিজ্ঞান-গবেষণা যে মানব-মনস্তত্ত্ব ও আচরণবিজ্ঞানের একটি দিক খুলে দিল তাতে সন্দেহ নেই।

Advertisement

সমাজ, রাজনীতি, দৈনন্দিন জীবনেও কি এই বিজ্ঞানসিদ্ধান্ত তাৎপর্যবহ নয়? কুবাক্যের প্রয়োগও যে হিংসা তথা নিগ্রহ, এবং সে কারণেই তা পরিহার্য আর তা না হলে দণ্ডনীয়, তা মানবার সময় এসেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিগ্রহকারী— সে তিনি রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি বা দোর্দণ্ডপ্রতাপ গৃহকর্তা যে-ই হোন না কেন— আত্মপক্ষ সমর্থন করেন এই বলে যে, তিনি গায়ে হাত তোলেননি, মুখে বলেছেন মাত্র। বিজ্ঞান-প্রমাণ দেখালেও যে তাঁরা শুধরাবেন তা নয়, তবে আসল কথা, এই হিংসার প্রতিরোধ দরকার ব্যক্তিক থেকে সামূহিক সব স্তরে। সংসার সমাজ বা রাষ্ট্র, সর্বত্র হিংসার চাষ হয় মুখের কথাতেই, এবং তার পার পেয়ে যাওয়ার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। কুবাক্যের ব্যবহারে লিঙ্গভেদ নেই, ২০২১-এ অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, সঙ্গী ও শিশুদের নিগ্রহ করেন এমন নারীদের মধ্যে ৮৬ শতাংশেরও বেশি হাতিয়ার হিংসাত্মক শব্দ— শারীরিক বা আবেগগত নিগ্রহের থেকে অনেক বেশি। তথাকথিত লিঙ্গসাম্যের রাষ্ট্রেই যখন এই, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, ভারতের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় কুবাক্যের বিস্তার কত বহুল ও ‘স্বাভাবিক’। চলচ্চিত্র, সিরিয়াল, ওয়েব সিরিজ়, জনসংস্কৃতিতে তার ‘বাস্তবসম্মত’ প্রদর্শন হিমশৈলের চূড়ামাত্র।

শব্দের হিংসা সম্পর্কে এক দিকে যেমন চাই সচেতনতা, অন্য দিকে প্রয়োজন এই সংক্রান্ত আইনও। ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৪ বা ৫০৯ ধারায়, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারায় উল্লিখিত রয়েছে এমন কাজ বা আচরণের কথা, যার অপরাধযোগ্যতার সঙ্গে কুরুচিকর, অশ্লীল তথা কু-কথার সম্পর্কটি ঘনিষ্ঠ। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ খুব চোখে পড়ে না। কুকথার প্রতিবাদে মানহানির অভিযোগ, আইনি নোটিস বা মামলা; কিংবা বিবাহবিচ্ছেদের মতো পরিস্থিতিবিশেষে সঙ্গীর ‘নিষ্ঠুরতা’র নিদর্শন হিসেবে কুশব্দকে তুলে ধরা— এ-ই চার পাশে চোখে পড়ে বেশি। তুল্যমূল্য বিচারে এখনও শারীরিক নিগ্রহের পাশে বাচিক হিংসা তত সামাজিক গুরুত্ব পায় না, বাজে কথাকে বক্তার ‘মুখের’ তথা ‘কথার কথা’ ধরে নেওয়াতেই সমস্যা। বাচিক হিংসা স্বীকৃত মহাভারত-এও; সুপ্রাচীন থেকে অত্যাধুনিক যাকে স্বীকার করছে, ভারতের সমাজ আর কত দিন তা বুঝেও না বোঝার ভান করবে?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement