ফাইল চিত্র।
উত্তরপ্রদেশ এখন ভারতীয় জনতা পার্টির নিকট এক বৃহৎ প্রশ্নপ্রদেশ। রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন আসিতে এক বৎসরও বাকি নাই। নির্বাচনে দলের ফলাফল কী দাঁড়াইবে, সেই প্রশ্ন এখন নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার সতীর্থদের গভীর উদ্বেগের কারণ। গত কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া বিজেপির জাতীয়স্তরের দল-কর্তারা লখনউ সফর করিয়াছেন, সেখানে দলের বিধায়ক ও রাজ্যস্তরের নেতাদের সহিত বৈঠক করিয়াছেন। তাহার পরে দিল্লিতে গিয়াছেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, দুই দিন ধরিয়া প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি সভাপতি-সহ দলনায়কদের সহিত দীর্ঘ আলাপ করিয়াছেন। আলাপ শেষে অমিত শাহকে মূল্যবান সময় দিবার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ এবং নরেন্দ্র মোদীকে ‘হৃদয়তল’ হইতে কৃতজ্ঞতাও জানাইয়াছেন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর রাজধানী লখনউ হইলেও তাঁহার কণ্ঠে এমন বিগলিত বাণী শুনিবার অভ্যাস রাজ্য বা দেশের মানুষের নাই। সুতরাং, নাগরিকরা পরস্পর বলিতেছেন: বুঝ লোক যে জানো সন্ধান।
এই পরিস্থিতির প্রথম ও প্রধান দায় যোগী আদিত্যনাথের। ২০১৭ সালে হাতে ক্ষমতা পাইবার পরমুহূর্ত হইতে তাঁহার দুঃশাসনের উৎকট রূপটি উত্তরোত্তর খুলিতে থাকে। কেবল সংখ্যালঘু নহে, সাধারণ ভাবেই দুর্বলের উপর প্রবলের অত্যাচারের ধারাবাহিক পিশাচলীলা চলিতে থাকে দেশের সর্বাপেক্ষা জনবহুল রাজ্যটিতে, যাহার মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে ‘এনকাউন্টার’-এর জয়গানে মুখর। সম্প্রতি মাফিয়া-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় হইয়া উঠিবার ‘অপরাধে’ নিষ্ঠুর ভাবে নিধন করা হইল সাংবাদিক সুলভ শ্রীবাস্তবকে। এহেন নিকৃষ্ট ঘটনা উত্তরপ্রদেশে এখন একের পর এক ঘটিতেছে। এবং মুখ্যমন্ত্রী হয় নিষ্ক্রিয়, নতুবা অপরাধীর মদতদাতা হিসাবে নিজেকে উদ্ঘাটিত করিতেছেন। আপন দলে এবং সরকারে সহকর্মীদের উপরেও তাঁহার যথেচ্ছ দাপট চলিতেছে। তাঁহার দৌলতেই রাজপুত মুখ্যমন্ত্রী এবং ব্রাহ্মণদের পারস্পরিক বিরাগ সনাতন ভারতের হৃদয়পুরের রাজনীতিতে এখন প্রকাশ্য। সঙ্গে যুক্ত হইয়াছে কোভিড অতিমারির মোকাবিলায় যোগীর চূড়ান্ত ব্যর্থতা, ভয়াবহ ঔদাসীন্য এবং সেই হৃদয়হীন অপদার্থতাকে আড়াল করিবার জন্য ক্ষমতার নির্লজ্জ অপব্যবহার, যাহার পরিণামে অসুস্থ স্বজনের জন্য অক্সিজেনের আবেদন জানাইয়াও নাগরিক প্রশাসনের কোপদৃষ্টিতে পড়িয়াছেন। অপরাধ শেষ অবধি আড়াল করা যায় নাই, নদীতে ভাসিয়া যাওয়া এবং বালিতে পুঁতিয়া দেওয়া মৃতদেহের সারি রাজ্য ও দেশের সীমা ছাড়াইয়া দুনিয়ার হাটে বহুলপ্রচারিত হইয়াছে, যোগী আদিত্যনাথের নাম অতিমারির চলৎ-চিত্রে চিরতরে খোদিত হইয়াছে— গভীরতম কলঙ্কের অক্ষরে। কোভিডে মৃত্যুর ‘প্রকৃত সংখ্যা’ যে সরকারি ভাষ্য অপেক্ষা অনেক বেশি, সেই অভিযোগও ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক।
ইহার প্রভাব পড়িতেছে মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার দলের নির্বাচনী পুঁজিতে। সম্প্রতি, রাজ্যের পঞ্চায়েত স্তরের নির্বাচনে বিজেপি বড় রকমের ধাক্কা খাইয়াছে, এমনকি অযোধ্যা এবং মথুরার মতো ‘ঘাঁটি’তেও। মোদী-শাহ এবং পারিষদবর্গ এই ধাক্কা সামাল দিতে তৎপর হইবেন, যোগী আদিত্যনাথকে দলীয় ও সরকারি সহকর্মীদের প্রতি, বিশেষত আপন বলয়ের বাহিরে থাকা অন্য জাতিবর্ণ ও গোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতি নমনীয় হইতে উপদেশ দিবেন নিশ্চয়। পাশাপাশি বিক্ষুব্ধদের অসন্তোষ কমাইবার চেষ্টাও চলিবে, কংগ্রেসের জিতিন প্রসাদকে দলে টানিয়া ব্রাহ্মণ ক্ষোভ প্রশমিত করিবার তৎপরতা যাহার একটি প্রাথমিক সঙ্কেত। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যে কঠিন ঠাঁই, প্রধানমন্ত্রী তাহা বিলক্ষণ জানেন; কিন্তু ব্যর্থ, দুর্বিনীত মুখ্যমন্ত্রীকে সরাইয়া দিবার উপায় কিংবা সাধ্য মোদী-শাহের নাই। আপাতত প্রলেপ এবং জড়িবুটিই চলিবে।