জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যায় অভিযুক্ত পুলিশ অফিসার ডেরেক শভিনকে দোষী সাব্যস্ত করিল আমেরিকার আদালত। গত বৎসর মে মাসে বিশ্বময় ছড়াইয়া পড়িয়াছিল ভিডিয়ো, কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের ঘাড় হাঁটু দিয়া চাপিয়া রাখিয়াছে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ শভিন। নয় মিনিট ঊনত্রিশ সেকেন্ডের সেই বীভৎসতায় পৃথিবী শিহরিয়া উঠিয়াছিল, আমেরিকা জুড়িয়া শুরু হইয়াছিল ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন। শভিনের বিরুদ্ধে মামলা হইতে দেরি হয় নাই, আন্দোলনের সমান্তরালে বিচার চলিতেছিল। ফ্লয়েডের আত্মজন, সাধারণ মানুষ হইতে শুরু করিয়া প্রেসিডেন্ট বাইডেন, সকলেই এই রায়কে অভিনন্দন জানাইয়াছেন। কমলা হ্যারিস বলিয়াছেন ‘জর্জ ফ্লয়েড বিল’ পাশের মাধ্যমে পুলিশি সংস্কারের কথা।
নাগরিকের গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করিতে যুগ যুগ ধরিয়া আন্তরিক প্রয়াস করিয়াছে যে আমেরিকা, সেই দেশ ইহাও দেখিয়াছে— নাগরিক হত্যায় পুলিশের দোষী সাব্যস্ত হওয়া দূরস্থান, অভিযোগও ধোপে টিকে না। ফ্লয়েড-হত্যার বিচার দেখাইয়াছে, আমেরিকার পুলিশ প্রশাসনের অন্দরে বর্ণবিদ্বেষ ও দমন-পীড়নের চারা কেমন ডালপালা ছড়াইয়াছে। সেই জায়গা হইতে দেখিলে শভিনের বিচার পুলিশি ব্যবস্থাকে মানবিক হইবার, আশু পাল্টাইবার আহ্বান; সর্বোপরি আইনের শাসনের সম্মুখে যে আইনরক্ষকও সমান দায়বদ্ধ, তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দেওয়া। এই রায় এই কারণেই ঐতিহাসিক। বিচারপ্রক্রিয়ার দ্রুততার জন্য তাহা আরও সাধুবাদযোগ্য। এক বৎসর পূর্ণ হইবার আগেই সিদ্ধান্ত হইয়াছে। শুনানি হইয়াছে দ্রুত, অনাবশ্যক বিলম্ব না করিয়া। তিন সপ্তাহের চূড়ান্ত বিচারপ্রক্রিয়া শেষে বারো জন জুরি শভিনকে দোষী সাব্যস্ত করিতে সময় নিয়াছেন মাত্র দশ ঘণ্টা। সাজা ঘোষণাও দুই মাসের মধ্যেই হইবে।
শুধু আমেরিকা কেন, সমগ্র বিশ্বের জন্যই কি এই বিচারপ্রক্রিয়া দৃষ্টান্ত হইবার উপযোগী নহে? ফ্লয়েডের ঘটনায় সংবাদমাধ্যমের বিবেকী প্রচার, নাগরিক সমাজের দৃঢ় অবস্থান, রাজনৈতিক বিতর্ক, সকলেরই অবদান রহিয়াছে— কিন্তু দিন-শেষে আসল কাজটি করিতে হয় বিচারব্যবস্থাকেই। আইনের শাসন ও উপযুক্ত বিচারপ্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দিয়া, দ্রুততার সহিত অথচ সুষ্ঠু ভাবে বিচার করিতে পারিবার মধ্যেই নাগরিকের ন্যায়বিচারের অধিকারটি নিশ্চিত হয়— আমেরিকার আদালতের এই কৃতিত্ব ভারতের জন্য শিক্ষণীয়। ভারতও এমন এক দেশ, যেখানে বাস্তবের পুলিশ প্রশাসন হইতে চলচ্চিত্রের পর্দা ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’দের কৃতিত্ব বর্ণনায় তৎপর, এই দেশেও পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা অগণিত এবং অনেক ক্ষেত্রেই জাতি-বর্ণ-ধর্মবিদ্বেষ দ্বারা প্রভাবিত বলিয়াও দেখা গিয়াছে। পুলিশ বা প্রভাবশালীর এহেন দুষ্কৃতি অনেক ক্ষেত্রেই আদালত অবধি পৌঁছায় না বলিয়া অভিযোগ, আর পৌঁছাইলেও আটকাইয়া যায় অতিবিলম্বিত বিচারপ্রক্রিয়ায়। আশির দশকে উত্তরপ্রদেশের হাশিমপুরা হত্যাকাণ্ডের বিচারে তিন দশক গড়াইয়া যাইবার ঘটনা বা সাম্প্রতিক কালে তামিলনাড়ুতে পুলিশি হেফাজতে পিতা-পুত্রের মৃত্যু মনে করায়, ভারতে বিচারপ্রক্রিয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত চ্যুতি যত, আবশ্যক দ্রুতি তত নহে। ফ্লয়েড-হত্যা মামলার দৃষ্টান্ত চোখের সামনে দেখিয়াও না শিখিলে তাহা নিতান্ত আক্ষেপের।