কয়েক বছর আগে এক অনলাইন নিলাম সংস্থার তালিকায় নাম উঠেছিল এক বিচিত্র বস্তুর— অস্ট্রেলিয়ার এক বাসিন্দা নিলামে তুলে দিয়েছিলেন নিউ জ়িল্যান্ড দেশটাকেই! ন্যূনতম দাম রেখেছিলেন মাত্র এক সেন্ট। নিলামে দর উঠেছিল ১২,০০০ ডলার— তবে, বিক্রি হয়ে যায়নি নিউ জ়িল্যান্ড। জানাজানি হওয়ামাত্র নিলাম থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় দেশটির নাম। দেশ বিক্রি না হলেও অবশ্য দেশের শাসকের আসনটি বিক্রির ইতিহাস প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো। ১৯২ খ্রিস্টাব্দে নিলাম হয়েছিল রোমের শাসনক্ষমতা। রাজ-সেনাবাহিনীর থেকে সাম্রাজ্য কিনেছিলেন দিদিয়াস জুলিয়ানুস। নিলামের ইতিহাস আরও পুরনো— প্রাচীনতম ঐতিহাসিক নিদর্শনটি ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের, ব্যাবিলনে। অতএব, দিনকয়েক পরে সৌদি আরবের জেড্ডায় আইপিএল-এর যে নিলাম বসতে চলেছে, বলা চলে তা এক প্রাচীন প্রথার উত্তরাধিকার। অর্থনৈতিক সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে নিলামের ব্যবহার ঘটে গোটা দুনিয়াতেই— কয়লাখনি বা টেলিকম স্পেকট্রামের মতো রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে শিল্পদ্রব্য, পেট্রোলিয়াম বা ফুল, সবেরই কেনাবেচা হয় নিলামের মাধ্যমে। টেন্ডার বা দরপত্রের মাধ্যমে কাজ পাওয়া, তা-ও এক গোত্রের বিশুদ্ধ নিলাম। শেয়ার বাজারের কেনা-বেচাও নিলামই। অর্থশাস্ত্রের তাত্ত্বিক ভাবনায় নিলামই হল কোনও জিনিসের দাম নির্ধারণের শ্রেষ্ঠ পন্থা। আইপিএল-এর নিলামের কথাই যদি ধরা যায়, সেখানে প্রতি বারই দু’একটা চমক থাকে— এমন কয়েক জন ক্রিকেটার থাকেন, যাঁদের বেস প্রাইস বা সর্বনিম্ন মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে কোনও দল তাঁদের কিনে নেয়। অর্থাৎ, প্রাথমিক ভাবে তাঁদের খেলোয়াড়ি দক্ষতার মূল্য যা হবে বলে ভাবা গিয়েছিল, কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ‘বাজার’ তাঁদের অনেক বেশি মূল্যবান বলে মনে করছে। আবার, উল্টোটাও হয়। কিন্তু, এ কথা অনস্বীকার্য যে, আইপিএল নামক প্রতিযোগিতা ঘিরে ‘বাজার’-এর যে উদ্যাপন চলে, নিলামের আসরটি তার প্রকৃষ্টতম পরিসর।
আইপিএল-এ যে পদ্ধতিতে নিলাম হয়, তার নাম ব্রিটিশ অকশন। সেখানে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের একটি বেস প্রাইস বা সর্বনিম্ন দর থাকে, এবং তাঁদের নাম নিলামে এলে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলি সেই খেলোয়াড়ের জন্য দর হাঁকতে থাকে। যে দল সর্বোচ্চ দর হাঁকে, তারাই সেই খেলোয়াড়কে পায়। এটি নিলামের পরিচিততম পদ্ধতি বটে, তবে একমাত্র নয়। ব্রিটিশ অকশনের উল্টো দিকে থাকবে ডাচ অকশন, যেখানে নিলাম পরিচালক কোনও একটি পণ্যের জন্য একটি সর্বোচ্চ দর হাঁকেন, এবং ক্রমেই সেই দর কমাতে থাকেন যত ক্ষণ না কেউ কোনও একটি দরে সেই পণ্যটি কিনতে সম্মত হন। বন্ধ লেফাফায় দর জমা দেওয়াও নিলামের একটি পদ্ধতি। আবার, শেয়ার বাজার যে পদ্ধতিতে চলে, তার নাম ডাবল অকশন।
ব্রিটিশ অকশন গোত্রের নিলামের ক্ষেত্রে একটি কথা অতি-প্রচলিত: ‘উইনার্স কার্স’ বা ‘বিজয়ীর অভিশাপ’। অর্থাৎ, যিনি নিলামে জেতেন, বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, তিনি যে দরে জিনিসটি কিনলেন, তা জিনিসটির থেকে প্রাপ্ত মূল্যের চেয়ে ঢের বেশি। তাত্ত্বিক ভাবে এমন ঘটা অসম্ভব, কারণ এই গোত্রের নিলামে ডমিন্যান্ট স্ট্র্যাটেজি বা শ্রেষ্ঠ কৌশল হল, পণ্যটির প্রত্যাশিত মূল্যের চেয়ে নিজের সর্বোচ্চ দরটি কম রাখা। কিন্তু, মানবচরিত্র আর কবেই বা তাত্ত্বিক রণকৌশলের তোয়াক্কা করেছে! নিলামে ক্রেতার যুক্তিবোধকে প্রভাবিত করতে পারে অনেকগুলি বিষয়, যার মধ্যে একটি হল পণ্যটির বেস প্রাইস বা নির্ধারিত সর্বনিম্ন মূল্য। সেই দামটি যদি তুলনায় চড়া হয়, তবে পণ্যটির বিক্রয়মূল্যও শেষ অবধি তার প্রত্যাশিত মূল্যের চেয়ে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। আচরণবাদী অর্থশাস্ত্রের তত্ত্বে একে বলা হয় অ্যাঙ্করিং এফেক্ট। কোনও একটি পণ্যের জন্য অন্যরা প্রচুর দর হাঁকছেন, এটিও কাউকে তাঁর নিজস্ব বিবেচনার গণ্ডি অতিক্রম করতে বাধ্য করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সেই ক্রেতার মনে একটি সংশয় তৈরি হয় যে, অন্যরা যখন পণ্যটিকে আরও মূল্যবান মনে করছেন, তখন সম্ভবত সে বিষয়ে এমন কোনও তথ্য আছে, যা সম্বন্ধে আমি অবগত নই। অতএব, নিজের বিবেচনা বাদ দিয়ে অন্যদের অনুসরণ করার প্রবণতা বা ‘হার্ডিং’-ও নিলামের আসরে পরিচিত ঘটনা। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিলাম শেষ হবে, এই চাপও অনেককে প্রয়োজনের তুলনায় অধিকতর ঝুঁকি নিতে বাধ্য করে। ফলে, নিলামে নাম লেখানো ক্রিকেটাররা আশা করতেই পারেন যে, তাঁরা শেষ অবধি প্রত্যাশিত দরের তুলনায় বেশি দর পাবেন।