অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার হইতেছে স্বাস্থ্যসাথী বিমা প্রকল্পের অধীনে, জানিয়া বড়ই উদ্বিগ্ন হইয়াছেন পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য কর্তারা। বিমার অপব্যবহারের সম্ভাবনায় তাঁহারা ইতিপূর্বেই ‘সিজ়ারিয়ান সেকশন’ অর্থাৎ অস্ত্রোপচারের দ্বারা প্রসবে রাশ টানিয়াছিলেন, এই বার ‘ফিশারেক্টমি,’ অর্থাৎ মলদ্বারের ক্ষতে অস্ত্রোপচারেও বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা করিলেন। তাহার কারণ, মাত্র এক বৎসরে এই অস্ত্রোপচারের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হইয়াছে। অতএব নূতন নিয়ম, সরকারি হাসপাতালের ছাড়পত্র ব্যতীত বেসরকারি হাসপাতালে এই সকল অস্ত্রোপচার করা যাইবে না। এই সংশোধনকে স্বাগত জানাইয়াও বলিতে হয়, ভুল হইতে শিক্ষাগ্রহণে এত বিলম্ব কেন? কেন এতগুলি নাগরিককে অকারণ চিকিৎসার যন্ত্রণা সহিতে হইল, রোগ আরও জটিল হইবার ঝুঁকি বহিতে হইল, কেনই বা এত অপচয় হইল রাজকোষ হইতে? সরকারি উদ্যোগে স্বাস্থ্যবিমায় কী প্রকার চিকিৎসা সঙ্কট এবং আর্থিক দুর্নীতি হইতে পারে, তাহার নিদর্শন কি বহু পূর্বেই সম্মুখে আসে নাই? দরিদ্রের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা শুরু হইয়াছিল ২০০৮ সালে। তাহার কয়েক বৎসরের মধ্যে নানা রাজ্য হইতে তথ্য মিলিতে লাগিল যে, কয়েক ধরনের অস্ত্রোপচারের সংখ্যা অস্বাভাবিক বাড়িয়াছে। প্রসব এবং ছানি কাটিবার অস্ত্রোপচার সেইগুলির শীর্ষে। তৎসহ রহিয়াছে জরায়ু অপসারণ। বিহারের সমস্তিপুর এবং রাজস্থানের দাউসা জেলায় জরায়ু অপসারণ এমন অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়িয়া যায়, যে সরকার নড়িয়া বসিতে বাধ্য হয়। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার চারটি ব্লকে একটি সমীক্ষা দেখাইয়াছিল, পঞ্চাশ বৎসর-অনূর্ধ্ব ব্যক্তিদের ছানি কাটিবার, এবং চল্লিশ বৎসর-অনূর্ধ্ব মহিলাদের জরায়ু অপসারণের সংখ্যা উদ্বেগজনক। অথচ, চিকিৎসাশাস্ত্রে তাহা সাধারণত বিহিত নহে। ২০১২ সালের ওই সমীক্ষা স্পষ্ট করিয়াছিল যে, পশ্চিমবঙ্গেও সরকারি স্বাস্থ্য বিমার সুযোগ লইতে অকারণ অস্ত্রোপচার, অথবা ভুয়া অস্ত্রোপচার বাড়িতেছে। তাহা হইলে প্রতিরোধের চেষ্টা হয় নাই কেন?
বিশেষত, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প রূপায়িত হইয়াছে ২০১৬ সালে। সরকারি নথিতে তত দিনে স্বাস্থ্যবিমায় দুর্নীতির প্রবণতার আরও বিস্তারিত প্রতিফলন হইবার কথা। তৎসত্ত্বেও স্বাস্থ্যসাথীর পরিকল্পনার সময়েই যে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনার ভুলগুলি সংশোধনের সার্বিক প্রচেষ্টা হইল না, ইহা বড়ই আক্ষেপের কথা। জরায়ু, অ্যাপেনডিক্স, আর গল-ব্লাডার, এই প্রত্যঙ্গগুলি অপসারিত করিলে দেহ অত্যধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। সরকারি স্বাস্থ্যবিমার প্রয়োগ হইলে এইগুলির অস্ত্রোপচারই বাড়িয়া যায়, অতীতে তাহার সাক্ষ্য মিলিয়াছে। এই কারণে স্বাস্থ্যস্বাথী প্রকল্পে অন্তত এই রোগগুলির উপরে প্রথম হইতেই নজরদারির প্রয়োজন ছিল। বিবিধ অস্ত্রোপচারের পরিসংখ্যান খতাইয়া দেখিবার, এবং সর্বসমক্ষে প্রকাশ করিবার কি প্রয়োজন নাই? বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসায় অর্থব্যয়ের বিশ্লেষণ হইতে বিমার প্রকৃত উপযোগিতা সম্পর্কে, এবং সফলতর প্রয়োগ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।
কেবল সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি এবং অপচয় এড়াইবার জন্যই তাহার প্রয়োজন, এমনও নহে। যথাযথ এবং সুরক্ষিত স্বাস্থ্য পরিষেবার উদ্দেশ্যও ব্যাহত হইতেছে। ম্যালেরিয়া, ডায়ারিয়া, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, রক্তচাপজনিত নানা সমস্যা— এই অসুখগুলির চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল পরিষেবার সর্বাধিক প্রয়োজন হয়। কিন্তু বিমা-অধীন চিকিৎসার নকশা অন্য প্রকার। অস্ত্রোপচার অধিক লাভজনক বলিয়া বিমায় নানাবিধ অস্ত্রোপচারের প্রাধান্য অধিক। তাহার অর্থ, এক দিকে জরুরি চিকিৎসায় অর্থ সহায়তার অভাব হইতেছে, অপর দিকে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার চলিতেছে। এই দুই সঙ্কট হইতে বাঁচিতে হইলে স্বাস্থ্যবিমার প্রয়োগ সম্পর্কে রাজ্যকে আরও অনেক স্বচ্ছ ও সতর্ক হইতে হইবে।