নিমপাতা বা কাঁচা হলুদের অনেক গুণ। কিন্তু, তা দিয়ে ক্যানসারের চিকিৎসা সম্ভব, এমন দাবি করলে মুশকিল। প্রাক্তন ক্রিকেটার ও রাজনীতিক নভজ্যোৎ সিংহ সিধু বলেছেন, নিমপাতা, কাঁচা হলুদ, লবঙ্গ, ভেষজ পানীয় গ্রহণ করা এবং ‘ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’ বা দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার অভ্যাসগুলি তাঁর স্ত্রী-কে চল্লিশ দিনের মধ্যে স্টেজ ফোর স্তন ক্যানসার থেকে সেরে উঠতে সাহায্য করেছে। চিকিৎসকরা স্বভাবতই বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ। তাঁরা জানিয়েছেন, ক্যানসারের এ-হেন নিরাময়ের কোনও বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ এখনও মেলেনি। অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি এবং রেডিয়েশন থেরাপির মতো প্রচলিত বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার উপরেই মানুষকে আস্থা রাখতে বলেছেন তাঁরা। সিধু-ও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন, যথাযথ চিকিৎসা ও ওষুধেই সুস্থ হয়েছেন তাঁর স্ত্রী। স্বাস্থ্যকর খাদ্য ও উপোস সেই চিকিৎসাপদ্ধতির ছিল অংশমাত্র।
ভারতে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারতে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৪.১৩ লক্ষ, যার মধ্যে ব্রেস্ট ক্যানসারের প্রকোপ ছিল অন্যতম। দেশে ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গভীর আর্থ-সামাজিক অসামঞ্জস্য অন্যতম অন্তরায় হলেও, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য পরিকাঠামোও এই রোগের নির্ণয় ও নিরাময়ের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী যেখানে আড়াই লক্ষ মানুষ প্রতি একটি রেডিয়ো থেরাপি মেশিন থাকা উচিত, সেখানে ভারতে এই যন্ত্র রয়েছে প্রতি ১৫ লক্ষে একটি। লক্ষণীয়, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ বাস করেন গ্রামাঞ্চলে, অথচ প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্যানসার কেয়ার সেন্টারই রয়েছে শহরে। অন্য দিকে, সিআরআইএসপিআর-এর মতো অত্যাধুনিক জিন এডিটিং প্রক্রিয়া বা আইআইটি বম্বে-র সিএআর-টি সেল থেরাপি ক্যানসার চিকিৎসায় বিপ্লব ঘটালেও, এ দেশের ক্ষেত্রে তা পর্যাপ্ত নয়। তা ছাড়া, এই রোগের চিকিৎসা এতটাই ব্যয়বহুল যে, বহু পরিবারই তা বহন করতে অক্ষম।
তাই স্বাভাবিক ভাবেই ক্যানসার ধরা পড়লে রোগী ও তাঁর পরিবার ন্যূনতম আশাটুকু আঁকড়ে ধরতে চান। প্রচলিত চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনে অপারগ হয়ে অবৈজ্ঞানিক তত্ত্বে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। ক্যানসার নিরাময়ের ক্ষেত্রে এটিও অন্যতম বাধা। এই অবস্থায় সিধুর মতো তারকাদের অবৈজ্ঞানিক দাবি রোগী ও তাঁর পরিবারকে বিভ্রান্ত করতে পারে। কারণ, এ জাতীয় ‘ঘরোয়া টোটকা’ তাঁদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে সেগুলির সহজলভ্যতা এবং সামান্য দামের কারণে। এই সহজলভ্য ও ‘খাঁটি দেশীয় পদ্ধতি’র চিকিৎসার একটি বিপুল বাজার আছে, এবং মানুষের অসচেতনতা ও অসহায়তা সেই বাজারের অন্যতম চালিকাশক্তি— এই কথাটিও ভুলে গেলে চলবে না। কোভিডকালে এমনই সস্তায় বিশল্যকরণীর ব্যবসা ফেঁদে বসেছিল স্বঘোষিত যোগগুরুর বাণিজ্যিক সংস্থাটি। আদালতের কঠোর অবস্থানে তারা আপাতত সংযত হতে বাধ্য হয়েছে। সিধুর মতো তারকারা সেই অনৈতিক বাণিজ্যের অন্য দিকটি— অসচেতনতার প্রসারে তাঁরা সহায়ক। নেহাত ভুলস্বীকার বা ক্ষমাপ্রার্থনা নয়, এ-হেন দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য তাঁর শাস্তি হওয়া জরুরি ছিল। নচেৎ, মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রবণতা কমবে না।