Government Hospital

মাতৃঘাতী

এপ্রিল-জুন ২০২৪, এই তিন মাসে এ রাজ্যে প্রসূতিমৃত্যুর অনুপাত বেড়ে দাঁড়িয়েছিল এক লক্ষে ১০৩, যা জাতীয় হার (৯৭) ছাড়িয়েছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ০৪:১৬
Share:

এক মাতৃহারা নবজাতকের সামনে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই রাজ্য। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে মামণি রুইদাসের মৃত্যু প্রশাসনের কর্তব্যবিমুখ, অ-সংবেদী মুখটিই ফের প্রকাশ করল। স্যালাইন অথবা অক্সিটোসিন ইনজেকশনে দূষণের জন্য প্রসূতির মৃত্যু হচ্ছে, এমন সন্দেহ এই প্রথম নয়। গত কয়েক বছরে নানা মেডিক্যাল কলেজে দেখা গিয়েছে, অস্ত্রোপচার করে প্রসবের পরে একাধিক প্রসূতির অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়েছে, কয়েকটি মৃত্যুও ঘটেছে। এপ্রিল-জুন ২০২৪, এই তিন মাসে এ রাজ্যে প্রসূতিমৃত্যুর অনুপাত বেড়ে দাঁড়িয়েছিল এক লক্ষে ১০৩, যা জাতীয় হার (৯৭) ছাড়িয়েছিল। এর সম্ভাব্য কারণ অস্ত্রোপচারের সময়ে প্রয়োগ করা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, এমন মত প্রকাশ করেছিলেন কর্মরত চিকিৎসকেরা। প্রতিটি ঘটনার পরেই স্বাস্থ্য দফতরের তরফে তদন্ত হয়েছে, ওষুধের নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু প্রতিকারের জন্য কী করা হয়েছে, জানা যায়নি। ফলে ফের এক প্রসূতির মৃত্যু হল, আরও চার জনের প্রাণসঙ্কট ঘটল। সম্ভাব্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছে কালো তালিকাভুক্ত সংস্থার স্যালাইনের ব্যবহার। অক্সিটোসিন সুরক্ষিত রাখতে ‘কোল্ড চেন’ যথাযথ সংরক্ষিত হয়েছে কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশে এমন ঘটনা ঘটলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার শীর্ষ কর্তারাও তদন্তের মুখে পড়তেন। নৈতিক দায় স্বীকার করতেন। কিন্তু রাজ্যটি পশ্চিমবঙ্গ, শাসক দল তৃণমূল। অতএব তদন্তের ফল যদি বা প্রকাশ হয়, দোষ চাপানো হবে (যদি হয়) এক বা একাধিক অধস্তনের উপরে, এমনই প্রত্যাশিত। ক্ষতিপূরণও ঘোষণা হতে পারে। পাশাপাশি, সরকারি বয়ানের বাইরে যে কোনও তথ্য-প্রমাণকে নস্যাৎ বা নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করবে শাসক দল, সরকারি চিকিৎসকদের ধমক দিয়ে চুপ করাবে, তা-ও অবধারিত।

Advertisement

তা সত্ত্বেও উত্তর দাবি করতে থাকবে কিছু নাছোড় প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্নটি এ রাজ্যের ওষুধ পরীক্ষার ব্যবস্থাকে নিয়ে। বিভিন্ন সময়ে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা স্যালাইন, অক্সিটোসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখে, বা সেগুলিকে অকেজো দেখে, মান পরীক্ষা করতে পাঠিয়েছেন। প্রায় কোনও ক্ষেত্রে সমস্যা পাওয়া যায়নি। অথচ, সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের একটি সংস্থার স্যালাইনের বিরুদ্ধে কর্নাটক সরকার অভিযোগ করে। তার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ওষুধের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা (সিডিএসসিও) এবং রাজ্যের আধিকারিকরা তদন্তে গিয়ে বিস্তর গোলমাল পান। সংস্থাটিকে নিষিদ্ধও করা হল। প্রশ্ন ওঠে, এ রাজ্যের উৎপাদকদের উপর তা হলে রাজ্য সরকারের নজরদারি কতটুকু? কর্নাটক সরকার নালিশ না করলে কি বাংলার লোক দূষিত স্যালাইনের খবর পেত না? সংবাদে প্রকাশ, রাজ্যে ওষুধের মান পরীক্ষার পরিকাঠামোয় বহু ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতির অর্থ যে বহু প্রাণের বিপন্নতা, সরকার কি তা বোঝে না? দ্বিতীয় প্রশ্ন, স্যালাইন উৎপাদক সংস্থাকে ১০ ডিসেম্বর নিষিদ্ধ করল স্বাস্থ্য ভবন, অথচ তার উৎপাদিত স্যালাইন ব্যবহারে নিষেধ জারি করল এক মাস পরে। এ কি কেবলই অবহেলা, না কি এখানেও দুর্নীতির দুর্গন্ধ, সে সন্দেহ দেখা দিতে বাধ্য।

তৃণমূল সরকার ‘মা, মাটি, মানুষ’ স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। এ দিকে ২০১৫-১৭ সালে যখন প্রসূতিমৃত্যুর জাতীয় হার ছিল এক লক্ষে ১২২, তখন এ রাজ্যে ছিল ৯৪। অতঃপর দেশ এগিয়েছে, রাজ্য পিছিয়েছে। তামিলনাড়ুর প্রসূতিমৃত্যু হার আজ পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেক। ২০২৩-২৪ সালে ১১৬২ জন প্রসূতির মৃত্যু ঘটেছিল পশ্চিমবঙ্গে। কেন্দ্রের নিয়ম অনুসারে প্রতিটি ক্ষেত্রে দীর্ঘ রিপোর্ট জমা পড়েছে স্বাস্থ্য ভবনে। সেগুলি থেকে সরকার শিক্ষা নেয়নি, তার প্রমাণ নতুন বছরের গোড়াতেই মামণি রুইদাসের মৃত্যু। কেন পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতাল মায়েদের জন্য নিরাপদ নয়, সে প্রশ্ন তুলবেই বা কে? স্বচ্ছতার দাবি এ রাজ্যে রাজনৈতিক বিরোধিতায় পর্যবসিত হয়েছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement