জামিনের অধিকার রক্ষিত হচ্ছে না।
এক দিকে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তির অমৃত মহোৎসব, অন্য দিকে স্বাধীন দেশের সরকারের যুগল বার্তা: বিলকিস বানোর নির্যাতনকারীদের জেলমুক্তি, এবং তিস্তা শেতলবাদের জামিন অস্বীকার। দু’টি ঘটনা আলাদা। কিন্তু দু’টি ঘটনার প্রেক্ষাপট একই, এবং ঘটনা ঘটানোর প্রণোদনাটিও একই। গুজরাতের ২০০২ সাল মুসলিমনিধনের যে রিপোর্ট ও তদন্ত করছিলেন তিস্তা, তাতে নাকি নিরীহ ব্যক্তিরা অকারণে অভিযুক্ত ও অত্যাচারিত হয়েছিলেন। আবার সেই একই দৃষ্টিভঙ্গিতে, অন্তঃসত্ত্বা বিলকিস বানো ও তাঁর শিশুর উপর নির্যাতন যাঁরা চালিয়েছিলেন, তাঁরা জবরদস্ত প্রমাণের অভাবে মুক্তি পাওয়ার অধিকারী। বেশি মন্তব্যের দরকার নেই, এই দুই ঘটনাকে পাশাপাশি রাখলেই বক্তব্য স্পষ্ট ভাবে প্রতিভাত হয়। দুই মাসেরও বেশি হয়ে গেল সমাজকর্মী তথা মানবাধিকার কর্মী তিস্তা শেতলবাদ বন্দি। ইতিমধ্যে অবশ্য তিস্তার আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট গুজরাত রাজ্য সরকারকে নোটিস পাঠিয়ে দু’দিনের মধ্যে উত্তর চেয়েছে। তবে এই সমস্ত ঘটনার মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধে আছে যে মূল ব্যাপারটি তা হল— গোধরা-পরবর্তী গুজরাত দাঙ্গা প্রসঙ্গে ‘মিথ্যা তথ্যপ্রমাণ’ দিয়েছেন যাঁরা তাঁদের ‘বিচার হওয়া দরকার’, সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য তথা নির্দেশের এই নির্বাচিত অংশকে হাতিয়ার করে হিন্দুত্ববাদী সমাজের আস্ফালন ও হুঙ্কার।
এই মুহূর্তে তিস্তার গ্রেফতারির বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে ও বিদেশ থেকেও বিশিষ্টজনের সম্মিলিত প্রতিবাদ চলছে। ২৫ জুন গুজরাত পুলিশ তাঁকে আটক করার অব্যবহিতেই রাষ্ট্রপুঞ্জের আধিকারিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, গ্রেফতারির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল মানবাধিকার সংস্থা ‘ফ্রন্টলাইন ডিফেন্ডারস’ থেকে ‘অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়া’ও। অতি সম্প্রতি বিবৃতি দিয়েছেন নোম চমস্কি, ভিখু পারেখ, ওয়েন্ডি ব্রাউন, শেলডন পোলক-এর মতো বিদ্বজ্জন ও তাত্ত্বিকেরা। গোধরা-পরবর্তী গুজরাত দাঙ্গায় অভিযুক্তদের ক্লিন চিট দিয়েছিল সিট, তিস্তা-সহ আবেদনকারীরা সেই রিপোর্টকেই চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন। যে রিপোর্ট নিজেই প্রশ্নাতীত নয়, তার ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্ট কী করে তিস্তাদের আবেদন খারিজ করে দিতে পারে, এই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। উপরন্তু, আবেদন খারিজ করতে গিয়ে এমন কথা বলা যা উল্টে আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে যায়, হয়ে ওঠে নাগরিকের দমন-পীড়নে পুলিশ তথা রাষ্ট্রের হাতিয়ার, যেমন দেখা গেল গুজরাত পুলিশের অতি তৎপরতায় তিস্তার গ্রেফতারিতে— আইনশাস্ত্র ও বিচারপ্রক্রিয়ায় তা অভিপ্রেত নয়, এও বলেছেন তাঁরা।
তবু আশা শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টই, ভারত ও তার নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় যে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ও কৃতি অপরিসীম, সুদূরপ্রসারী। সুপ্রিম কোর্ট বহু বার বলা সত্ত্বেও জামিনের অধিকার রক্ষিত হচ্ছে না, ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় এটাই সত্য। তবে কিনা, মহামান্য আদালতও নিশ্চয় অবহিত, এই ঘটনার মধ্যে জামিন-সঙ্কটটি হিমশৈলের চূড়ামাত্র। হিমশৈলটি যে রকম, তার আকার ও প্রকার ভারতীয় গণতন্ত্রকে ডুবিয়ে দেওয়ার মতোই ভয়ানক। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে শাসনবিভাগের পক্ষপাতের সঙ্গে যদি যুক্ত হয় বিচারবিভাগের উদাসীনতা— তা হলে চরম দুর্ভাগ্যের দিকে যাত্রা ভিন্ন গতি নেই।