রাজ্যপালের পদটি ব্যবহৃত হয়েছে বিরোধীশাসিত রাজ্যে কেন্দ্রের কলকাঠি নাড়ার কাজে। প্রতীকী ছবি।
রাজ্যপালরা একই সঙ্গে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান, এবং রাজ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি। ফলে, শক্তিশালী কেন্দ্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয়তার শর্তে বলীয়ান রাজ্যের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে রাজ্যপালদের ভূমিকা গুরুতর হওয়া সঙ্গত ছিল। দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরের ইতিহাস কার্যত তেমন ভূমিকার সাক্ষী থাকেনি বললেই চলে। রাজ্যপালের পদটি ব্যবহৃত হয়েছে বিরোধীশাসিত রাজ্যে কেন্দ্রের কলকাঠি নাড়ার কাজে। রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে ক্ষোভের ইতিহাসও দীর্ঘ দিনের। বিভিন্ন সময়ে নানান কমিশন রাজ্যপালের ভূমিকা বিষয়ে মন্তব্য করেছে, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। তার প্রত্যেকটিরই পরিপ্রেক্ষিত ছিল বিশেষত ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে রাজ্যপালদের ভূমিকার সাংবিধানিকতা নিয়ে সুগভীর প্রশ্ন। ভারতীয় গণতন্ত্রের দুর্ভাগ্য যে, পরিস্থিতি পাল্টায়নি। গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গ, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, কেরল, মহারাষ্ট্র-সহ বিভিন্ন বিরোধীশাসিত রাজ্যে রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে নির্বাচিত সরকার তীব্র আপত্তি প্রকাশ করেছে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন যে সে রাজ্যের রাজ্যপালের অপসারণের দাবিতে সমমনস্ক রাজনৈতিক দলগুলির সমর্থন প্রার্থনা করেছেন, তা এই সার্বিক পরিস্থিতিরই আরও একটি প্রকাশ।
রাজ্যপালের প্রশ্নটি সামনে রেখে বিরোধী দলগুলির জোট রাজনীতিও নতুন ঘটনা নয়। আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার বিজেপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে দাবি করেছিল, রাজ্যপাল নির্বাচিত হোন রাজ্যের পাঠানো প্যানেল থেকেই। এবং, সেই নির্বাচনের অধিকারও কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে নয়, থাকুক রাজ্যগুলির যৌথ সভার হাতে। সে দিনের বিরোধী বিজেপি আজকের শাসকসত্তায় রাজ্যপালের পদের অপব্যবহারকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। ১৯৯৪ সালের এস আর বোম্মাই মামলার রায়ের পর রাজ্যপালের পদের অপব্যবহারের প্রবণতায় যে ভাটা পড়েছিল, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি সেই গাঙে ফের জোয়ার এনেছে। আইনসভায় সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের সময় নির্ধারণ, সরকার গঠনের জন্য বিশেষ দলের প্রতি পক্ষপাত থেকে আরম্ভ করে সরকার পরিচালনার প্রাত্যহিক কাজে হস্তক্ষেপ, বিভিন্ন বিল আটকে রাখা বা ফেরত পাঠানো, সরকারের নীতি সম্বন্ধে জনসমক্ষে অবাঞ্ছিত মন্তব্য করা, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার কাজে অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ— বিজেপির আমলে রাজ্যপালরা বিরোধীশাসিত রাজ্যগুলিতে যে ভূমিকা পালন করেছেন, ভারতের ইতিহাসেও তা বিশেষ উল্লেখের দাবিদার। বারে বারেই সংশয় হয়েছে, রাজ্যপালকে ব্যবহার করে বিরোধী রাজ্যে অস্থিরতা তৈরি করার ক্ষেত্রে কোনও রাখঢাকের প্রয়োজন বুঝি ফুরিয়েছে। রাজ্যপালদের কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিরোধও বহু দিন পরে তুঙ্গে উঠেছে।
সেই রাজনীতির পরিসরে তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান দেখে বলতে ইচ্ছা করে, ‘কিউরিয়াসার অ্যান্ড কিউরিয়াসার’। কংগ্রেস ও বামপন্থী দল-সহ বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল যখন ডিএমকে নেতা এম কে স্ট্যালিনের পাশে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করেছে, তখন তৃণমূল জানিয়েছে, তারা সে জোটে নেই। কেন, তার কিছু কারণও দলের তরফে উল্লেখ করা হয়েছে বটে, কিন্তু সেগুলিকে আলোচনার পরিসরে এনে তাকে মর্যাদা দান করা অপ্রয়োজনীয়। ২০২৪-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী রাজনীতির জোট সমীকরণ যখন দানা বাঁধছে, তখন বিভিন্ন প্রশ্নে তৃণমূল যে ভঙ্গিতে সেই জোটের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছে, রাজ্যপাল-কেন্দ্রিক সংঘাতটি তার আর একটি উদাহরণ। এই রাজ্যে গত পাঁচ বছরে রাজভবনকে ঘিরে যে বিপুল রাজনৈতিক চাপানউতোর চলেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে এই উদাহরণটি তাৎপর্যপূর্ণ বটে।