—প্রতীকী চিত্র।
সাধারণ নির্বাচনের ফল প্রকাশের এই দিনটিকে যদি অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যে এক সেতু হিসাবে কল্পনা করা হয়, ভুল হবে না। ভোটদান এবং তার বিপুল প্রস্তুতি ও প্রচারের পর্ব এখন অতীত, ভবিষ্যৎ রচনা করবে নতুন লোকসভা ও নতুন সরকার। অতীতের জঠর থেকেই ভবিষ্যৎ নিষ্ক্রান্ত হতে চলেছে, আজ সেই পর্বান্তরের মাহেন্দ্রক্ষণ। এই লগ্নটির গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্যক ভাবে উপলব্ধি করার জন্য যে সুস্থিত চিন্তার পরিবেশ আবশ্যক, অধুনা দেশে তার ঘোর অনটন। এখন উন্মাদনার কাল, দ্রুতগামী ক্রিকেট ম্যাচের মতোই প্রতি মুহূর্তে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ভেসে আসতে থাকা ফলাফল নিয়ে অনন্ত উত্তেজনায় ফুটতে ফুটতে অনর্গল কথামালা রচনার কাল। এই বেলাগাম উচ্ছ্বাসের বাহুল্য নিয়ে আক্ষেপ করা হয়তো অর্থহীন— যুগধর্ম কেন বাধ্যতে? কিন্তু ভোটের ফলাফল জানা হয়ে যাওয়ার পরে সেই উচ্ছ্বাসের ফেনা সরে গেলে সচেতন এবং সুচেতন নাগরিক গণতান্ত্রিক ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেঈষৎ ভাববেন, না নতুন কোনও উন্মাদনার তরঙ্গে আপনাকে ভাসিয়ে দেবেন, আজকের এই পর্বান্তরের সেতুতে দাঁড়িয়ে সে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
ওঠা জরুরি। জরুরি, কারণ ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আজ আর নিশ্চিন্ত থাকার কোনও উপায় নেই। কুরাজনীতি এবং দুঃশাসনের দাপটে কী ভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং রীতিনীতি ক্রমাগত লাঞ্ছিত হয়ে চলেছে, সে-বিষয়ে বহু আলোচনার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু যে নির্বাচনের ফল সমাসন্ন, তার সমগ্র প্রক্রিয়াটি নিয়েও কম সংশয় এবং উদ্বেগ সৃষ্টি হয়নি। বিভাজন, বিদ্বেষ, অপপ্রচার বা মিথ্যাভাষণের প্লাবন তো দেখা গিয়েছেই, এমনকি নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও বড় রকমের প্রশ্ন উঠেছে, যে প্রশ্নকে উড়িয়ে দেওয়ার কোনও উপায় নেই। এই অতীতকে পিছনে ফেলে যদি ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হয়, সেই ভবিষ্যৎকে যদি সত্যকারের গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে হয়, তবে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত এবং দলগত ভাবে তার দায় স্বীকার করতে হবে সমস্ত সুনাগরিককে। নির্বাচনী ফলাফলের নতুন সূচনাবিন্দু থেকে নির্বাচন-উত্তর রাজনীতির অনুশীলনের মধ্যে দিয়েই গণতন্ত্রের মর্যাদা পুনরুদ্ধারে তৎপর হতে হবে।
এই কাজটি কেবল দেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ সমগ্র বিশ্বের পক্ষেও। মনে রাখা দরকার, স্বাধীন সার্বভৌম ভারত তার জন্মলগ্ন থেকে জগৎসভায় যে সম্মান অর্জন করেছিল, তার প্রথম এবং প্রধান কারণ ছিল এই দেশের গণতান্ত্রিক আদর্শ ও তার নিরন্তর অনুশীলন। অনেক বাধা, বিস্তর ত্রুটি, বহু ব্যর্থতা নিয়েই সেই অনুশীলন চলেছে। তার গুরুত্ব কার্যত গোটা দুনিয়া একবাক্যে স্বীকার করেছিল, তার জন্য দেশের নেতা মন্ত্রী আমলাবর্গকে প্রাণপণে নিজের ঢাক পেটাতে হয়নি। আজ বিশ্বের কূটনৈতিক মঞ্চে ভারতের যেটুকু সম্মান বা কার্যকারিতা অবশিষ্ট আছে, তার পিছনে এই ঐতিহাসিক মর্যাদার অবদান বিপুল। কিন্তু, দুঃখের কথা এবং ভয়ের কথা, সেই মর্যাদা ক্রমশই ইতিহাসে পরিণত হচ্ছে। দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে ধারাবাহিক ভাবে ভারতে গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণ সম্পর্কে নিরন্তর গভীর উদ্বেগের সুর ভেসে আসছে, স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতার বিবিধ আন্তর্জাতিক সূচকে ভারতের স্থান উত্তরোত্তর পিছনের সারি থেকে আরও পিছনের সারিতে অপস্রিয়মাণ। নির্বাচনী ফলাফলের পাটিগণিত যেমনই দাঁড়াক না কেন, এই বড় ছবিটিকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব না দিলে ভারতের পক্ষে তার গণতান্ত্রিক মর্যাদা ফিরে পাওয়া কঠিন হবে। সেই পরিণাম কেবল এই দেশের পক্ষে নয়, বিশ্বের পক্ষেও দুর্ভাগ্যজনক হবে। দুনিয়া জুড়েই এখন গণতন্ত্রের বিরোধী শক্তিগুলির দাপট বাড়ছে। ভারত তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্রের সাধনায় ফিরতে পারবে কি না, তার উত্তর আছে ভবিষ্যতের পেটিকায়। কিন্তু ভবিষ্যৎ কখনও পূর্বনির্ধারিত হয় না, নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগে তাকে গড়তে হয়।