—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি। Sourced by the ABP
আরও এক বার গুরুতর প্রশ্ন উঠল রাজ্যপালদের নিয়ে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন বললেন, ভারতের বহু রাজ্যপালই এমন কাজ করছেন যা তাঁদের কর্তব্য নয়; এবং যেগুলি প্রকৃত কর্তব্য, তেমন কাজে অবহেলা করছেন। রাজ্যপালের এক্তিয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের হচ্ছে— এই ঘটনাকে ‘দুঃখের কাহিনি’ আখ্যা দিলেন বিচারপতি। অস্বীকারের উপায় নেই, গত দশ বছরে বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের বিরোধ ক্রমেই তীব্রতর হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ তার স্পষ্ট উদাহরণ— সি ভি আনন্দ বোসের সঙ্গে রাজ্য সরকারের বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর পূর্বসূরি জগদীপ ধনখড়ের সময়কালকে রীতিমতো বন্ধুত্বপূর্ণ বলে ভ্রম হতে পারে। শুধু পশ্চিমবঙ্গই নয়, তামিলনাড়ু, কর্নাটক বা কেরলের মতো রাজ্যেও সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের বিরোধ বারে বারেই উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছচ্ছে। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিবৃতি, সরকারের পাঠানো বিলে সম্মতি না দিয়ে তাকে ফেরত পাঠানো, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্নে সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ— এর কোনওটিই রাজ্যপাল পদের পক্ষে শোভন নয়, এগুলি রাজ্যপালের কর্তব্যও নয়। ভুলে যাওয়ার কোনও কারণ নেই যে, রাজ্যপালদের দৃশ্যমান হওয়ার কথা, শ্রাব্য নয়। খাতায়-কলমে রাজ্যের সরকার রাজ্যপালের অধীন— কিন্তু, গণতন্ত্রের ধর্ম মেনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের উপরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দ্বারা প্রেরিত রাজ্যপালের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা চলে না। বস্তুত, ভারতীয় সংবিধানে রাজ্যপালের পদ একটি নিখাদ ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার— ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন থেকে তা সরাসরি ঠাঁই পেয়েছিল ভারতীয় সংবিধানে। সংবিধান প্রবর্তনের ৭৪ বছর পূর্ণ হয়েছে— রাজ্যপালের পদটি আদৌ আর রাখা প্রয়োজন কি না, সে কথা কি ভেবে দেখা যায়?
রাজ্যপাল যদি তাঁর পদের অঘোষিত শর্ত মেনে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক প্রশ্নগুলিতে নিষ্ক্রিয় থাকতেন, এবং সমাজজীবনে গণতন্ত্র-প্রজাতন্ত্রের মহিমা বজায় রাখার কাজে আত্মনিয়োগ করতেন, তা হলে পদটি নিয়ে এত প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু আজ বলে নয়, দীর্ঘ দিন ধরেই বিরোধী দল-শাসিত রাজ্যে রাজ্যপালরা কাজ করেছেন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধি হিসাবে। নরেন্দ্র মোদীর আমলে এই প্রবণতা অতীতের সব সীমা লঙ্ঘন করেছে। ভারতীয় রাজনীতির বাস্তব জানে, বর্তমান জমানায় রাজ্যপাল পদে নিয়োগের প্রধানতম শর্তই হল কেন্দ্রীয় শাসকদের প্রতি আনুগত্য। রাষ্ট্রপতি পদটিও নির্বাচন-সাপেক্ষ, কিন্তু রাজ্যপাল পদটি নয়। সেখানে নিয়োগ সম্পূর্ণত কেন্দ্রীয় শাসকদের ইচ্ছায়। পদটি থাকবে কি না, অথবা এক দফা মেয়াদ ফুরোলে আরও এক বার নিযুক্ত হওয়া যাবে কি না, সবই নির্ভর করে কেন্দ্রীয় শাসকদের মর্জির উপরে। ফলে, শাসকদের প্রতি অনুগত হওয়ার প্রণোদনা স্পষ্ট। এ কথা অনস্বীকার্য যে, গণতন্ত্রের প্রতি কারও অটুট সম্মান থাকলে তিনি এই প্রণোদনাকে অস্বীকার করতে পারেন— কিন্তু, কোনও কালেই তেমন মানুষ সুলভ ছিলেন না, এখন সেটুকুও নেই।
প্রশ্নটি অবশ্য ব্যক্তিবিশেষকে নিয়ে নয়, প্রশ্ন নীতি নিয়ে। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এমনিতেই কেন্দ্রের প্রতি ঝুঁকে থাকে। রাজনৈতিক স্তরে রাজ্যপালের পদটি কেন্দ্রীয় শাসকদের হাতে ক্ষমতার আয়ুধবিশেষ— রাজ্য সরকারের উপরে ছড়ি ঘোরানোর পন্থা। রাজ্য সরকারের হাতে রাজ্যপালকে বরখাস্ত করার উপায় নেই। ফলে, রাজ ভবনগুলি কাজ করতে থাকে রাজ্যের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের পরিপন্থী ক্ষমতাকেন্দ্র হিসাবে। সেখানে ভরসা কেবলমাত্র রাজ্যপালের রাজনৈতিক সদিচ্ছা— তাঁর পদের অলিখিত শর্তগুলি মেনে চলার সদিচ্ছা। ব্যক্তির সদিচ্ছার উপরে ভর করে কোনও ব্যবস্থা পরিচালনা অতি বিপজ্জনক। সেই বিপদের প্রমাণ প্রতিনিয়ত মিলছে। বিচারপতি নাগরত্নের কথাগুলি আরও এক বার সে কথা স্মরণ করিয়ে দিল।