সুপ্রিম কোর্ট। —ফাইল চিত্র।
একটি আপাত-অকিঞ্চিৎকর মামলাও কী ভাবে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর চরিত্র নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, সম্প্রতি তার একটি নিদর্শন মিলল। একটি মামলায় মধ্যপ্রদেশ হাই কোর্ট বিবাদীর জামিনের শর্ত হিসাবে নির্দেশ দিয়েছিল যে, বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা অভিযুক্তের বাড়িটি পুলিশ দখল করবে, এবং তা বাদী পক্ষের হাতে তুলে দেবে। সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হলে শীর্ষ আদালত জানায়, কোনও অবস্থাতেই পুলিশ কোনও নাগরিকের স্থাবর সম্পত্তি দখল ও হস্তান্তর করতে পারে না। কোনও আইনেই তেমন কোনও ব্যবস্থা নেই। বিচারপতি সি টি রবি কুমার ও বিচারপতি সন্দীপ মেহতার বেঞ্চ জানায়, পুলিশ এমন কাজ করলে তা সম্পূর্ণ ‘আইনহীনতা’য় পৌঁছবে, এবং নাগরিককে তাঁর ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে। শীর্ষ আদালতের এই রায় ভারতীয় সংবিধানের অন্তর্গত ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের কথা বলে। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে, এবং সংবিধান রচনার দীর্ঘ যাত্রাপথে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বহু বারই বিতর্কের কেন্দ্রে এসেছে। কিন্তু, সেই তর্কের নির্যাস থেকে উঠে এসেছে একটি অবস্থান— ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার অলঙ্ঘনীয়। ভারতে যে কোনও মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রেই একটি শর্ত প্রযোজ্য— ব্যক্তিবিশেষের অধিকার যত ক্ষণ না অন্য কারও অধিকার লঙ্ঘন করছে, অথবা সমাজের বৃহত্তর কোনও ক্ষতিসাধন করছে, তত দূরই ব্যক্তিগত অধিকারের সীমা। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের ক্ষেত্রেও তাই। সে সীমা লঙ্ঘিত না হলে কোনও যুক্তিতেই যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির দখল নিতে পারে না রাষ্ট্র— এবং, অতি অবশ্যই পুলিশ— আদালত সে কথাটি মনে করিয়ে দিয়েছে।
একটি লিবারাল বা উদারবাদী সমাজে সম্পত্তির অধিকার অনপনেয়। স্বাধীন ভারতে এই অধিকারটির অস্তিত্ব এক টানাপড়েনের আশ্চর্য ফল। দেশ যখন স্বাধীন হচ্ছে, যখন সংবিধান রচিত হচ্ছে, তখন তার অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল এক গোত্রের সমাজতান্ত্রিক ধারণা। স্বভাবত, সেই ধারণার অবস্থান লিবারাল ধারণার বিপ্রতীপে। কিন্তু, ভারতের ইতিহাস সাক্ষী, এ দেশে সব কিছুই এক বিশেষ আকার ধারণ করে। ফলে, ‘সমাজের সমাজতান্ত্রিক ধাঁচ’ এবং উদারবাদ এই ভারতে হাত ধরাধরি করে চলতে সম্মত হয়েছিল। সেই সমঝোতার একটি অলিখিত সূত্র হল, যে ব্যক্তিগত সম্পদের প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবহার আছে— যেমন, কারখানা ইত্যাদি— তার তুলনায় বসবাসের বাড়ির মতো সম্পদের ক্ষেত্রে অধিকারের ধারণাটি আরও বেশি পোক্ত। ফলে, আজ যদি পুলিশ সেই অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে চায়, এবং যদি তাকে আটকানো না হয়, তবে তা ভারতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি অতি সংবেদনশীল অবস্থানকে বিনষ্ট করবে।
কথাগুলি পুলিশকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া জরুরি। আরও বেশি জরুরি রাজনীতিকদের সতর্ক করা। যোগী আদিত্যনাথ শাসনের যে ‘বুলডোজ়ার মডেল’ চালু করেছেন, এবং বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে যে মডেল ক্রমেই জনপ্রিয়তর হয়ে উঠছে, তা প্রত্যক্ষ ভাবে সংবিধানস্বীকৃত ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের বিরোধী। আদিত্যনাথের মডেল বহু স্তরে অন্যায়। প্রথমত, অভিযোগ যে, তা ব্যবহৃত হয় নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের বা জাতিভুক্তদের বিরুদ্ধে। এই পক্ষপাত অবশ্য গৈরিক জাতীয়তাবাদের সমনামী। দ্বিতীয়ত, কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ উঠলেও তার শাস্তিবিধানের দায়িত্ব যে আদলতের; পুলিশ বা সরকারের নয়— এ কথাটি আদিত্যনাথরা ভুলিয়ে দিতে চান। তৃতীয় কথা হল, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ধ্বংস করা শাস্তিবিধানের পথ হতে পারে না। অভিযুক্তের ক্ষেত্রে তো নয়ই, এমনকি যাঁর অপরাধ প্রশ্নাতীত ভাবে প্রমাণিত, তাঁর ক্ষেত্রেও নয়। তা সরাসরি দেশের সংবিধানের অবমাননা। শীর্ষ আদালতের রায়টিকে যোগী আদিত্যনাথ-সহ বুলডোজ়ার-বান্ধব মুখ্যমন্ত্রীরা একটি চেতাবনি হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন।