Art Exhibition

আখ্যানের পথে চিত্রিত সময়ের অভিব্যক্তি

৫৫টি বাছাই মাধ্যমের প্লট অনুযায়ী মানানসই আয়োজনে মায়া আর্ট স্পেসের আয়তাকার পরিসর ছিল অত্যন্ত রুচিসম্মত।

Advertisement

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৫২
Share:

আবহমান: মায়া আর্ট স্পেসে শিল্পী শমিতা বসুর একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।

শমিতা বসুর সাম্প্রতিক চিত্র প্রদর্শনী নিয়ে আলোচনা করার আগে, শিল্পীর উৎসভূমিতে আলোকপাত করলে, তাঁকে বুঝতে সুবিধে হয়। শিল্পী তাঁর কাজের বহমানতায় ছাপ রেখেছেন নিজের শিকড়ের। কোনও জটিল তত্ত্বের পথে হাঁটেননি, হাঁটতে চানওনি। নিজেকে এ ভাবে ব্যক্ত করার নেপথ্যে রয়েছে শিল্পীর বাবা কবি মঙ্গলাচরণ চট্ট্যোপাধ্যায়ের বামপন্থী আদর্শ। ফলত সমাজে বঞ্চিত মানুষদের প্রতি শিল্পীর টান বরাবরের। প্রদর্শনীতে আমরা ঠিক সেই অনুভবেরই মৌলিক চিত্ররূপ দেখতে পাই।

Advertisement

৫৫টি বাছাই মাধ্যমের প্লট অনুযায়ী মানানসই আয়োজনে মায়া আর্ট স্পেসের আয়তাকার পরিসর ছিল অত্যন্ত রুচিসম্মত। প্রদর্শনীতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বেশির ভাগ প্যাস্টেল, চারকোল, কন্টির কাজ ছাড়াও ছিল জলরঙের পাঁচটি স্টিল লাইফ, যেটি শিল্পীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অন্যতম মুখপত্র বলা যেতে পারে। এতে বিশেষ করে বোঝা যায়, রং-প্রণালী ও স্টাডির যথার্থ পাঠ তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে শিল্পের চ্যালেঞ্জিং ভূমি তৈরি করতে।

আবহমান: মায়া আর্ট স্পেসে শিল্পী শমিতা বসুর একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

সমগ্র আয়োজনের যেটি মূল বৈশিষ্ট্য, তা হল, নিছক দেখার স্তর পেরিয়ে এ সব কাজে স্পষ্ট হয়ে ওঠে অনুভবী শিল্পীর সমাজচেতনা, একটি সামাজিক বার্তা। প্রদর্শনীতে পর্যায়ক্রমে নজর কাড়ে বেশ কিছু কাজ। যেমন বর্তমান সমাজে যেটি আমরা সবচেয়ে বেশি দেখি, তা হল শিশুশিক্ষার চূড়ান্ত অবক্ষয়। এই ক্ষোভ থেকে খানিকটা স্যাটায়ার-মিশ্রিত দৃষ্টিতে পেপারের উপরে কন্টি দিয়ে করা একটি কাজে দেখা যায়, বিচলিত সরস্বতী (সরস্বতী পারটার্বড)। সাদা-কালোর সংমিশ্রণে সরস্বতীর বিরক্ত ভঙ্গিতে প্রকাশ পায়, ভক্তদের চেয়ে নিজের কল্যাণ নিয়ে বেশি উদ্গ্রী‌ব তিনি। পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্কটকে সুন্দর ছন্দে বেঁধেছেন শিল্পী। আর একটি মোনোক্রমিক কাজ, ‘বোট বয়েজ় অব সুন্দরবন’-এ দেখা যায়, মাতলা নদীর উপরে আসন্ন প্রলয়ের প্রতিরোধে বয়স বাড়ে দুই কিশোর চালকের।

Advertisement

আবহমান: মায়া আর্ট স্পেসে শিল্পী শমিতা বসুর একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

‘রিয়্যাল টু এথরিয়্যাল’ শিরোনামের একটি কাজে জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত রেফারেন্সমূলক কাহিনি, চরম আকুলতার সাক্ষী হয়ে ওঠে। শিল্পী ছোটবেলা থেকেই স্কেচ করতেন। কিন্তু আর্টের দিকে যাওয়ার কথা কখনও ভাবেননি, পড়াশোনাতেই মন ছিল বেশি। লখনউ আর্ট স্কুলে ছিলেন শিল্পীর মেসোমশাই, ইন্দুপ্রকাশ মুখোপাধ্যায়। ললিতমোহন সেনের ছাত্র ছিলেন তিনি। যে সময়ে উনি কলকাতায়, সেই সময়ে শমিতাকে তিনি ট্রান্সপারেন্ট ওয়াটার কালার ড্রয়িং শেখানো শুরু করলেন। সেই সময়ে শিল্পীর বয়স ২৫ কি ২৬। পরবর্তী কালে স্বামীর কাজের সূত্রে মুম্বইয়ে সংসার পাতেন শমিতা। সেখানে গিয়েই পেশাদার ভাবে আঁকা শুরু। শিল্পী বরাবরই ফিগারেটিভ কাজ করতে ভালবাসেন। একটা গল্প বলার ব্যাপার থাকে তাঁর সব ছবিতেই।

আবহমান: মায়া আর্ট স্পেসে শিল্পী শমিতা বসুর একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

আধিপত্যের লালসা, কঠিন লড়াইয়ের জীবন, শ্রমিক শ্রেণির মুখ শিল্পীকে ছোট থেকেই টানে। তাই তাঁর ছবির ভাষায় বস্তুতই ফুটে ওঠে জীবনমুখী, রূঢ় বাস্তবের দুনিয়া। ‘অ্যাড্রেস আননোন’ এ রকমই একটি ছবির দলিল বলা যেতে পারে। স্টেশনে জড়ো হওয়া ছিন্নমূল মানুষের অসহায় ভিড়। তবুও লড়াই চলে। গভীর চিত্রপটে লাইট ইয়েলোর ফর্মে পরিপাটিহীন রেখা মুখর হয়ে ওঠে। পাশাপাশি অল্প আঁচড়ে ফুটে ওঠা ক্ষুব্ধ প্রতিকৃতি, রিকশাওয়ালার দৃপ্ত ভঙ্গিমা, দু’টি মেয়ের প্রেমকাহিনি নিয়ে তৈরি কাজগুলি অনবদ্য। অসম্ভব বাঙ্ময় আর একটি ছবি— চারকোল স্টিকে উপবিষ্ট মাতৃতন্ত্রের প্রতিভূ। এ ছাড়াও দেখা যায় ‘পুরুষ ও প্রকৃতি’ নামের সংঘর্ষজনিত একটি কাজে কমলা রঙের ঔজ্জ্বল্য। বিশেষ সংবেদী ছবি। ‘থ্রি থার্স্টি উইমেন’ নামক কাজটিতে দেখা যায়, গ্রীষ্মের দাবদাহে সড়ক ধরে ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত তিন রাজস্থানি নারীকে, নলকূপের সন্ধানে। প্যাস্টেলের চমৎকার প্রয়োগ।

শিল্পী শমিতার মতে, কমিউনিজ়মের তত্ত্বের ঠিক উল্টো পিঠে রয়েছে স্পিরিচুয়ালিটির মূলমন্ত্র। বস্তুত দুই-ই সমান। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রচুর পড়াশোনার পরে উঠে আসে শিল্পীর এক-একটি রচনা— ‘কৃষ্ণ অ্যান্ড দ্য গোপীজ়’, ‘দক্ষযজ্ঞ’, ‘হলাহল’, ‘অর্ধনারীশ্বর’, ‘গণেশের বিশ্ব’ ইত্যাদি। ভিরিডিয়ান, স্যাপ, ইয়েলো, ক্রোম-মিশ্রিত কৃষ্ণ-রাধার একাত্মকরণের একটি ছবি ছিল চোখে পড়ার মতো। ছবির নাম ‘ওয়াননেস’।

সাধারণত ব্যাকগ্রাউন্ডের কাজ ছাপিয়ে, কনসেপ্ট অনুযায়ী ফর্মের হালকা ছোঁয়া রেখে কাজ করতে পছন্দ করেন। করতে করতে কখনও শেপ গড়ে উঠলে, কোথাও ঘষে বা চেপে দিয়ে দ্রুত কাজ সারতে ভালবাসেন। বাস্তব থেকে অলৌকিক স্তরে যাওয়ার প্রতীক হিসেবে শিল্পী পেশ করেছেন ‘কৃষ্ণ ইন প্রোফাইল’ ছবিটি। তবে গোটা আয়তনের মধ্যে আর একটি ছবির আকর্ষণ ছিল সীমাহীন। পাতলা প্যাস্টেলের দাগে নিত্য দিনের দেখা ‘বেগার উয়োম্যান’কে সামনে বসিয়ে করা। এ প্রসঙ্গে শিল্পীর মনে পড়ে বাবার লেখার একটি লাইন, “মা, তোমার ঘর নেই, মাগো?”

‘দি অ্যাপিয়ারেন্স’ ছবিটি প্যাস্টেলের অত্যন্ত আধুনিক টেকনিকের একটি স্মার্ট কাজ। একজন একাকী মানুষ উটের পিঠে চড়ে তারা ভরা আকাশ অতিক্রম করছে। হঠাৎ করে একটি উজ্জ্বল জ্যোতি যদি সে দেখতে পায়, তাহলে কি সেই আগের মানুষই সে থাকবে? এই ভাবনা নিয়েই তৈরি কাজটি।

এমনই সব প্রশ্নের খোঁজে শিল্পী শমিতা বসুর শিল্পসম্ভার। তা ভবিষ্যতে আরও পূর্ণাঙ্গ রূপ নেবে, সেই প্রত্যাশায় থাকবেন দর্শকও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement