কুড়ি বৎসর পার করিল ৯/১১। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে যে বিমান হামলা তিন হাজার মানুষের প্রাণ কাড়িয়াছিল, তাহার জবাব দিবার উদ্দেশ্যে সূচিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ আজিও থামে নাই। বস্তুত যে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন সেই দিন আঘাত হানিয়াছিল, সেই আল কায়দা আজ হীনবল হইলেও তাহার আদর্শ বহমান, তাহারা দেশে-দেশে ইসলামি উগ্রপন্থীদের অনুপ্রেরণা। যুদ্ধও তাই চলিতেছে। এবং, এহ বাহ্য। বিমান উড়িবার দুই ঘণ্টা পূর্বে বিমানবন্দরে পৌঁছানো, সরকারি কার্যালয়ে নিরাপত্তার কড়াকড়ি, পথে-ঘাটে বহুবিধ নজরদারি, বহু শ্বেতাঙ্গের মনে অভিবাসী-বিরোধী ঘৃণা— ৯/১১-র এই সকল নিয়মই গড় আমেরিকার জীবনে স্বাভাবিক হইয়াছে। কুড়ি বৎসর পূর্বের সেই দিন আক্ষরিক অর্থেই আমেরিকাকে সমূলে পাল্টাইয়াছে— ভিতরে ও বাহিরে। দুই দশক পার করিয়া তাই প্রশ্ন উঠিতেছে: আমেরিকা কী করিতে পারিল? ওসামা বিন লাদেন আর নাই, ইহা যদি সুসংবাদ হয়, তবে তাঁহার কর্মভূমি আফগানিস্তানে তালিবানের প্রত্যাবর্তন ঘটিল। ওয়াশিংটনের পক্ষে ইহা অতি বড় দুঃসংবাদ।
লক্ষণীয়, কুড়ি বৎসরে প্রথম বার এমন এক ৯/১১ আসিয়াছে, যখন আমেরিকার কোনও সৈন্য আফগানিস্তানে নাই। কিন্তু কিসের বিনিময়ে? যে দেশ পুনর্গঠনে শতকোটি ডলার বিনিয়োগ করিয়াছিল ওয়াশিংটন, যাহার সরকারকে সব রকম সহায়তা করিতে তাহারা প্রস্তুত থাকিত, এবং যেখানকার নাগরিকদের সুস্থ জীবন তৈরি করিয়া দিতে অনেক বৎসরের পরিশ্রম ব্যয়িত হইয়াছিল, তাহাদের প্রস্থানের পর সেই দেশ এখন তড়িৎগতিতে সন্ত্রাসবাদী মুক্তক্ষেত্র। সেই দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম এই যুদ্ধে যদিও বহু আগেই পরাজিত হইয়াছিল আমেরিকা, তবু এমন অগৌরবের প্রত্যাবর্তনে তাহার লজ্জাজনক মাত্রাটি বিশ্বের সামনে উন্মোচিত হইল। এমনকি এই পশ্চাদপসরণ বিশ্ব-রাজনীতির ভারসাম্য বদলাইয়া দিবে কি না, তাহা লইয়াও কথা উঠিল। বলিতেই হয়, আমেরিকার শ্রমব্যয় বহুলাংশে জলে গিয়াছে। ৯/১১ যে যুদ্ধ শুরু করিয়াছিল, আমেরিকা কুড়ি বৎসর পরে, তাহার পরাজিত পক্ষ হিসাবে গোটা বিশ্বে প্রকাশিত হইয়াছে।
যে যে রাষ্ট্র আমেরিকার এই পরাজয়ে বিপদ গনিতেছে, তাহার মধ্যে অগ্রগণ্য ভারত। তালিবানের বিরুদ্ধে পঞ্জশির অঞ্চলে শেষ প্রতিরোধের চেষ্টাতেও আফগান যোদ্ধাদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহায়তার হাত বাড়ায় নাই নয়া দিল্লি, এক কালে যাহারা এই গোষ্ঠীকে অর্থ ও উপকরণ দিয়া প্রভূত সাহায্য করিত। বস্তুত, প্রতিবেশী দেশটিতে যাবতীয় ভারতবন্ধু রাজনৈতিক শক্তির বিলয় নয়া দিল্লির পক্ষে অতীব উদ্বেগজনক। সঙ্কটজনকও বটে। ভারত সম্ভবত তাহার সর্বাপেক্ষা জটিল কূটনৈতিক পর্বে প্রবেশ করিতে চলিয়াছে। এই মুহূর্তে ওয়াশিংটনের কার্যক্রম অনুসরণ না করিয়া ভারতের উপায় নাই। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে আমেরিকার ভরসাযোগ্য মিত্রের ভূমিকাতেই যে নয়া দিল্লি থাকিবে, তাহা এক প্রকার নিশ্চিত। অথচ, পাকিস্তান ও তালিবান আফগানিস্তানের অক্ষ তাহার সীমান্তে বিষাক্ত নিশ্বাস ফেলিবে, তাহাতেও সন্দেহ নাই। কাশ্মীর তো বটেই, দেশের অন্যত্রও অস্থিরতা বাড়িবার সম্ভাবনা। কুড়ি বৎসর পর, ৯/১১-র উত্তরাধিকারের গতিপথ ভারতের নিরাপত্তাকে বিরাট প্রশ্নের মুখে ঠেলিয়া দিল।