আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর আলোচনার সম্ভাবনা কয়েক ঘণ্টার নাটকীয় দোলাচলের পরে অন্তর্হিত হয়েছে, আন্দোলনকারীরা তাঁদের অবস্থানে ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু এক মাসের বেশি সময় ধরে তাঁদের কর্মবিরতির ফলে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছিল তা ‘পূর্বাবস্থা’য় ফিরে গিয়েছে বললে কম বলা হবে, অচলাবস্থা আপাতদৃষ্টিতে আরও সঙ্কটময়। প্রতিবাদীরা ‘দীর্ঘমেয়াদি’ লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এই জনশ্রুতি যদি সত্য হয়, উদ্বেগ প্রবলতর হতে বাধ্য। উদ্বেগ সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার সমস্যা ও অনিশ্চয়তা নিয়ে, জনজীবনের ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা নিয়ে, কিন্তু গভীরতম উদ্বেগ সরকারের সঙ্গে সমাজের আলোচনা ও কথোপকথনের পরিবেশ আরও প্রতিকূল ও অনাস্থাসঙ্কুল হয়ে ওঠার আশঙ্কা নিয়ে। গণতন্ত্র ‘আলোচনা-নির্ভর শাসন’; বৃহস্পতিবারের আলোচনা শুধু জুনিয়র চিকিৎসকদের কর্মবিরতি অবসানের জন্য জরুরি ছিল না, রাজ্যের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটি সচল সবল রাখতেও প্রয়োজনীয় ছিল। প্রয়োজন মেটেনি।
এই ব্যর্থতার পিছনে একটি বড় কারণ স্পষ্টতই আন্দোলনকারীদের কাছে শাসকদের বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব। দ্বিপাক্ষিক আলোচনা সরাসরি সম্প্রচার করতে হবে, সরকারি উদ্যোগে সেই আলোচনার ভিডিয়ো রেকর্ডিং করে রাখা যথেষ্ট নয়— প্রতিবাদীদের এই অবস্থানের মূল কারণ কী? আলোচনাসভায় যা ঘটবে এবং সরকারি রেকর্ডিং থেকে যা পাওয়া যাবে, দুইয়ের মধ্যে ফারাক থাকতে পারে, এমন আশঙ্কাই সম্ভবত এ ক্ষেত্রে চরম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবিশ্বাসকে শাসকরা অহেতুক বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও পারবেন না। অতীতের কথা সরিয়ে রাখলেও, এই আর জি কর কাণ্ডেই সরকারের আচরণ বারংবার গভীর সংশয়, সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন, সর্বোচ্চ আদালতে গত সোমবারের শুনানিতে হাসপাতালের সিসি ক্যামেরার তথ্য অসম্পূর্ণ থাকার পিছনে রাজ্য সরকারের তরফে যে প্রযুক্তিগত ত্রুটির (টেকনিক্যাল গ্লিচ) ‘যুক্তি’ শোনানো হয়েছিল, বৃহস্পতিবারের আলোচনাসভার রেকর্ডিং নিয়েও পরে তেমন কিছু ঘটত না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এই অনাস্থার বাস্তবটি স্বীকার করে নিয়ে রাজ্য সরকার সম্প্রচারের দাবি মেনে নিলে শাসকের অহংবোধে আঘাত লাগত বটে, কিন্তু গণতন্ত্রের পথ সুগম হত। অচলাবস্থা কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নৈতিক দায়িত্ব প্রথমত শাসকের উপরেই বর্তায়, কারণ তাঁরা শাসক।
কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। চিকিৎসকের নৈতিকতার প্রশ্ন। রাজ্যে জুনিয়র চিকিৎসকদের অনুপাত কত, তাঁরা কোন কোন চিকিৎসা করেন না, তাঁদের কর্মবিরতির ফলে কোথায় কত জন চিকিৎসা পাননি বা কত জনের মৃত্যু হয়েছে, সেই সব বিষয়ে পরিসংখ্যানের যে লড়াই চলছে, তা কেবল অসার নয়, নৈতিকতার বিচারে নিতান্ত গৌণ। মূল প্রশ্ন, চিকিৎসার কাজে কোনও ইচ্ছাকৃত বিরতি কি আদৌ সমর্থন করা যায়? অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, নিরাপত্তার সঙ্গত দাবিতে, প্রশাসনের বিপুল অপদার্থতা ও চূড়ান্ত অনাচারের আশঙ্কায় তাড়িত পরিবেশে অল্পকালের কর্মবিরতির পক্ষে হয়তো যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু সেই যুক্তি অনন্তকাল চলতে পারে না। বিশেষত, সরকারি হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল সাধারণ মানুষের জীবনমরণের প্রশ্ন যেখানে জড়িত। সরকারের চাপে নয়, নিজেদের নৈতিকতার প্রেরণায় আন্দোলনকারীদের কাজে যোগ দেওয়া উচিত। বস্তুত, এই কর্তব্য পালন করলে তাঁদের নৈতিক জোর আরও বহুগুণ বেড়ে যাবে, তাঁরা— কর্মরত অবস্থাতেই— সর্বসমক্ষে তাঁদের সঙ্গত ও গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলি নিয়ে কর্তৃপক্ষের উপর প্রবলতর চাপ সৃষ্টি করতে পারবেন। স্পষ্টতই, সেই কাজে নাগরিক সমাজের অকুণ্ঠ সমর্থনও পাবেন। শাসকের অনাচারের বিরুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় এই আন্দোলনের স্বার্থেই তাঁরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করুন। অবিলম্বে।