প্রতীকী চিত্র।
মাধ্যমিকে একশত শতাংশ পরীক্ষার্থী পাশ করিয়াছে। এ বার পরীক্ষা সরকারের। সকল স্কুল-উত্তীর্ণকে একাদশ শ্রেণিতে স্থান দিতে হইবে। এত দিন ফেল করিয়া, অথবা স্কুলছুট হইয়া ছাত্রছাত্রীরা সেই দায় হইতে সরকারকে নিষ্কৃতি দিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যাইতে পারে, ২০১৭ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১০ লক্ষ ৬০ হাজার, তাহাদের মধ্যে সাড়ে আট লক্ষ পাশ করিয়াছিল। দুই বৎসর পরে তাহাদের ৭ লক্ষ ৯০ হাজার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসিয়াছিল। এমন চিত্র বার বার দেখা গিয়াছে। অতিমারির পূর্বেও প্রতি বৎসর দশম হইতে দ্বাদশ শ্রেণির মধ্যে আড়াই-তিন লক্ষ ছাত্রছাত্রী শিক্ষা হইতে বিদায় লইয়াছে। মানবসম্পদের এই অপচয়কে কেহ ‘সমস্যা’ বলিয়া গণ্য করে না। অবশ্য ইহাও স্কুলছুটের সম্পূর্ণ চিত্র নহে। এই বৎসর যে পরীক্ষার্থীদের ‘একশত শতাংশ পাশ’ করিবার সংবাদে শোরগোল পড়িয়াছে, পঞ্চম শ্রেণিতে তাহাদের সংখ্যা ছিল ষোলো লক্ষেরও অধিক। মোট স্কুলশিক্ষার্থীর ৬২ শতাংশ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী হইয়াছে। পাঁচ বৎসরে যে পাঁচ লক্ষ শিশু স্কুলের অঙ্গন হইতে নীরবে ঝরিয়া গিয়াছে, তাহাদের জন্য কি দশম শ্রেণিতে আসন বরাদ্দ ছিল?
ছাত্র নাই বলিয়া আসন নাই, না কি আসন নাই বলিয়া ছাত্র নাই, এই প্রশ্ন বার বার করিতে হইবে। ভারতের অভিজ্ঞতা দেখাইয়াছে, সুযোগের অভাবেই শিক্ষার সঙ্কোচন হইয়া থাকে। কুড়ি বৎসর পূর্বে সর্বশিক্ষা অভিযানের সূচনা হইবার পর, এবং দশ বৎসর পূর্বে শিক্ষার অধিকার আইন পাশ হইবার পর স্কুলের সংখ্যা এবং শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা বাড়িয়াছে। পরিকাঠামোর বিস্তারের সহিত ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যাও ক্রমাগত বাড়িয়াছে। যাহার অর্থ, বহু বাবা-মা ঘরের নিকট বিদ্যালয়ের অভাবের জন্য সন্তানকে স্কুল পাঠাইতে পারিতেন না। এখন মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা একই ভাবে শিক্ষাকে সঙ্কুচিত করিতেছে। ইহা প্রকট উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভানেত্রীর কথায়। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলিয়াছেন, একাদশ শ্রেণিতে ঠিক কত আসন আছে, তাহা নথি দেখিয়া বলিতে হইবে। কত ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাইল, কত জন পাইল না, তাহা কি সকল স্তরের শিক্ষা আধিকারিকের ধ্যানেজ্ঞানে নিয়ত জ্বলজ্বল করিবার কথা নহে? তাহার নিরিখেই তো শিক্ষার অপর সকল পরিসংখ্যান অর্থবহ হয়। ভর্তির নানাবিধ শর্ত ঘোষণা করিয়া দরিদ্র, প্রান্তবাসী ছাত্রছাত্রীদের ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করিবার কাজটি সহজ। সকলের নিকট শিক্ষাকে উন্মুক্ত করিতে আপন ব্যর্থতা স্বীকার করা কঠিন।
একাদশে কত আসন আছে, বিশেষত প্রান্তিক এলাকাগুলিতে, দলিত-আদিবাসী, মুসলিম ও বালিকা বিদ্যালয়গুলিতে সেগুলির বণ্টনের নকশা কেমন, তাহা সত্বর প্রকাশ করিতে হইবে শিক্ষা দফতরকে। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে স্কুলকে কেবলই পরীক্ষায় নম্বর পাইবার কারখানা বলিয়া দেখা হয়। শিক্ষার সামাজিক ন্যায়ের দিকটি বরাবরই উপেক্ষিত। গুটিকতক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বাহিরেও যে শিক্ষার বিপুল উপযোগিতা রহিয়াছে, তাহা যে সকল শ্রেণির তরুণ-তরুণীর মধ্যে সক্ষমতা জন্মাইয়া সাম্যময় সমাজ গড়িতে পারে, তাহা যেন সরকারও ভুলিয়াছে। আজ দশ লক্ষ ছেলেমেয়ে পাশ করিয়া একাদশ শ্রেণিতে প্রবেশ দাবি করিতেছে। তাহাদের স্থান না দিতে পারিলে ফেল করিবে সরকার।