প্রতীকী ছবি।
অগ্রগতির পথে পশ্চিমবঙ্গ! অন্তত ভোটের দফা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রাজ্যের এই ‘উত্তরণ’ নজর এড়ায় না। ছয়, সাত পার করিয়া বাংলায় নির্বাচনী দফা এই বার আটে পৌঁছাইল। এতগুলি পর্বের নির্বাচন বাংলা আগে কখনও দেখে নাই। বস্তুত, কোনও রাজ্যেই এত দফায় ভোট হইয়াছিল বলিয়া জানা নাই। কোভিড ইহার সঙ্গত কারণ হইতে পারে না, কেননা এই বারেও কোভিড-আক্রান্ত দুই রাজ্য তামিলনাড়ু ও কেরলে এক দফায় ভোট সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত হইয়াছে। তামিলনাড়ুর আসনসংখ্যা ২৩৪, কেরলের ১৪০। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে ২৯৪ আসনের জন্য বরাদ্দ আট পর্ব। ২০১৬ সালে তৃণমূল এই রাজ্যে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসিবার কালে এখানে বিধানসভার ভোট হইয়াছিল ছয় দফায়। কেন্দ্রে তাহার আগেই বিজেপির নেতৃত্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত। এর পরে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে দফার সংখ্যা আরও একটি বাড়িয়া হয় সাত। এ বার সেই সীমাও অতিক্রান্ত। দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরা স্পষ্ট বলিয়াছেন, কোভিড পরিস্থিতি ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এই দফাবৃদ্ধির একটি কারণ। রাজনীতির মঞ্চ হইতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য ইহার নেপথ্যে নির্বাচন কমিশনের উপর কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির চাপসৃষ্টির কথা বলিয়াছেন। প্রশ্ন তুলিয়াছেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের ভূমিকা লইয়াও। সেই সবই রাজনীতির উপজীব্য।
প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ হইতে ভাবিলে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার বিষয়টি লইয়া অবশ্যই আলোচনার অবকাশ রহিয়াছে। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হইল, ভোটে অশান্তি এই রাজ্যে শিরোপাস্বরূপ। কয়েক দশকের স্মৃতি রোমন্থন করিলে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় কোনও নির্বাচনী বাতাবরণকেই শান্তিপূর্ণ বলা যাইবে না। কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করিয়া শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ এক দিনের বিষয়। সেখানে অশান্তি নিয়ন্ত্রণের মাপকাঠিও ভিন্ন। কিন্তু ভোটের সময় আইনশৃঙ্খলা বিচার তো এক দিনের নিরিখে করার নয়। তাহার কিছু পূর্বাপর থাকে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের চিত্র ধারাবাহিক ভাবেই কুয়াশাচ্ছন্ন। কেবল আজ নহে, সিপিএমের নেতৃত্বে অতীতের বামফ্রন্ট সরকারকেও সমদোষে অভিযুক্ত করার কারণ আছে। বর্তমান রাজত্বে মাত্র তিন বৎসর পূর্বের পঞ্চায়েত নির্বাচন তো নির্বাচনী কলঙ্কের এক নির্মম দৃষ্টান্ত হইয়া আছে। বিরোধী-শূন্য দখলদারি প্রতিষ্ঠায় মনোনয়ন পেশের দিন হইতে শাসক তৃণমূলের হিংস্র, অর্বাচীন দাপট দেখিবার যে অভিজ্ঞতা তখন রাজ্যবাসীর হইয়াছে, এত দ্রুত তাহা ভুলিবার কথা নয়। আবার বাম জমানার সন্ত্রাসও মানুষ জানেন। গ্রামে ভোটের আগে প্রতিপক্ষের বাড়িতে বিধবার থান পাঠাইয়া চরম পরিণতির বার্তা প্রেরণ, খাস কলিকাতায় ভোটদাতাদের ঘরবন্দি করিয়া রাখা, ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে সশস্ত্র হানা, গণনা কেন্দ্রে ঢুকিয়া সন্ত্রাস— কিছুই বাকি ছিল না। বড় জোর আঙ্গিকে কিছু পরিবর্তন ধরা পড়িতে পারে।
তথাপি শান্তিরক্ষায় আট দফার ভোট লাগে কি না, সেই প্রশ্ন বাতাসে ভাসমান। ইহার মধ্যে যে রাজনৈতিক কৌশলের আভাসও মিলিতেছে, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের ভূমিকা যথেষ্ট অর্থবহ। রাজভবনে আসিবার পর হইতে নিয়মিত রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা বলিয়া চলিয়াছেন তিনি। নবান্নের দিকে তর্জনী তুলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন, এই বার সুষ্ঠু নির্বাচন হইবেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে রাজ্যপালের রিপোর্ট গুরুত্ব পায়। আট পর্বে ভোট হইলে কোনও বিশেষ মহলের বিশেষ অভিপ্রায় ‘পূর্ণ’ হইবে কি না, বলা কঠিন। বলিলে ভুল হইবে না যে, কৌশলী বিজেপি প্রতিপক্ষ এই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতার সুযোগটিকে রাজনৈতিক ভাবে কাজে লাগানোর প্রলোভনটি ছাড়ে নাই।