গোটা দুনিয়ায় কার্যত সব দেশ টিকার সংস্থান করিবার জন্য দুইটি বিকল্প পথের একটি বাছিয়া লইয়াছিল— চিনের ন্যায় দেশ দেশের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যাহা প্রয়োজন, করিয়াছে; আমেরিকার ন্যায় দেশ বিশ্বের প্রধান টিকা উৎপাদকদের সহিত অগ্রিম চুক্তি করিয়া, টাকা মিটাইয়া টিকার বায়না করিয়া রাখিয়াছে। ভারত কোনও পথেই হাঁটে নাই। টিকার অভাবের কথা উঠিলে কর্তারা কখনও হুঙ্কার দিয়া বলিয়াছেন, সব ঝুট হ্যায়; কখনও আশ্বস্ত কণ্ঠে জানাইয়াছেন, ভারতই বিশ্বের ঔষধাগার— কাজেই, এই দেশে টিকার অভাব ঘটিবার কোনও কারণই নাই। কোন ভরসায় তাঁহারা এমন আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, তাঁহারাই জানেন— কারণ, নিতান্ত প্রাথমিক-পাঠ্য পাটিগণিতই বলিয়া দেয় যে, অগস্ট মাসের মধ্যে দেশের ৪০ কোটি মানুষকে দুই ডোজ় টিকা দেওয়ার ধারেকাছেও উৎপাদন ভারতে হইতেছে না। উৎপাদন বৃদ্ধি বা আমদানির চেষ্টা, কর্তারা কোনওটিই করিয়া উঠিতে পারেন নাই। বরং, কোভিড-এর দ্বিতীয় প্রবাহ আছড়াইয়া পড়িবার ফলে দেশে যখন টিকা লইয়া হাহাকার পড়িয়াছে, প্রধানমন্ত্রী তখন জানাইয়া দিলেন, আঠারো বৎসরের ঊর্ধ্বে সকলেই টিকা লইতে পারিবেন, কিন্তু তাহার ব্যবস্থা নিজেদেরই করিয়া লইতে হইবে। রাজ্যগুলিও টিকা কিনিয়া লইতে পারিবে, কিন্তু টাকা জোগাড়ের দায়িত্ব তাহাদেরই। অর্থাৎ, দীর্ঘ অপদার্থতার পর সম্পূর্ণ দায় ঝাড়িয়া ফেলা, এক কথায় ইহাই কেন্দ্রীয় সরকারের টিকা-নীতি।
প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থান একাধিক স্তরে অন্যায়। প্রথমত, যখন চাহিদা ও জোগানের মধ্যে এমন বিপুল ফারাক রহিয়াছে, তখন জোগান বাড়াইবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাটুকু না করিয়া সম্পূর্ণ দায় ঝাড়িয়া ফেলাকে নেতাসুলভ আচরণ বলা অসম্ভব। ইহা পলায়নি মনোবৃত্তি— দেশের মানুষ যখন এই অভূতপূর্ণ বিপদে নিমজ্জিত, প্রধানমন্ত্রী তখন দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকার করিলেন। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্য ফেব্রুয়ারি মাস হইতেই নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে টিকা কিনিবার অধিকারের দাবি জানাইতেছিল। নিয়ন্ত্রণের উদগ্র তাগিদে কেন্দ্র তাহাতে সম্মত হয় নাই। এখন সেই রাজ্যগুলির ঘাড়ে আর্থিক দায় চাপাইয়া দিতেছে। রাহুল গাঁধী যখন সব ভারতীয়ের জন্য টিকার ব্যবস্থা করিবার দাবি তুলিয়াছিলেন, কেন্দ্রীয় শাসকরা তাঁহাকে ‘ঔষধ শিল্পের দালালি’ করিবার অভিযোগে বিদ্ধ করিয়াছিলেন। সেই সিদ্ধান্তটিই তাঁহারা করিলেন, কিন্তু ব্যবস্থাপনার দায় লইলেন না। শাসকের কাজ যে শুধু বজ্রমুষ্টিতে নিয়ন্ত্রণ করা নহে, নাগরিকের স্বার্থে বিবিধ ব্যবস্থাপনা করাও বটে, এই কথাটি কেন্দ্রীয় কর্তারা বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছেন।
সিরাম ইনস্টিটিউট জানাইয়াছে, তাহারা বিভিন্ন দামে টিকা সরবরাহ করিতে চাহে— কেন্দ্রীয় সরকারকে ১৫০ টাকায়, রাজ্য সরকারকে ৪০০ টাকায়, এবং বেসরকারি হাসপাতালকে ৬০০ টাকায়। কেন্দ্রীয় সরকার কেন তাহাদের এই পথে চলিতে অনুমতি দিবে, তাহার কোনও উত্তর এখনও মিলে নাই। দেশের সংবিধান কেন্দ্রকে এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বহুবিধ ক্ষমতা দিয়াছে। তাহা প্রয়োগ করা হইবে না কেন? কেহ সন্দেহ করিতে পারেন, প্রকৃত প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় সরকার আরও এক দফা সঙ্কীর্ণ রাজনীতির খেলা খেলিতেছে— রাজ্যগুলি যাহাতে টিকাকরণে ব্যর্থ হয়, তাহার ক্ষেত্র প্রস্তুত করিতেছে। নচেৎ, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ক্ষেত্রে পৃথক দর মানিয়া লওয়ার কী কারণ থাকিতে পারে? বিশেষত, এই ক্রান্তিকালে টিকায় প্রত্যেক ভারতীয়ের অধিকার— এক অর্থে তাহাকে ‘পাবলিক গুড’ বলা চলিতে পারে। প্রত্যেক দেশবাসীকে বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করাই কি সরকারের কর্তব্য ছিল না? তাহার পরিবর্তে কুনাট্যের নূতনতর পর্বের সূচনা হইল।