Lok Sabha Election 2024

পরাজয়

সেই ১৯৫১-৫২ সালে প্রথম নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেনের তত্ত্বাবধানের সময় থেকে দৃষ্টান্তমূলক যত্নসহকারে যে কাজ হয়ে আসছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আঠারোতম জাতীয় নির্বাচনটিতে বিস্তর অস্বস্তি ও হতাশার কারণ ঘটেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২৪ ০৮:০৫
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

দেড় মাস সাত পর্বের দীর্ঘ কঠিন সময় কাটিয়ে এল ভারত। এবং নির্বাচনী ঘোষণার দিন থেকে শুরু করে আড়াই মাস ধরে কঠিন একটি পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেল দেশের নির্বাচন কমিশন। অবশ্যই ভারতের প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনই মহারাজসূয় যজ্ঞ, বিশ্বের মধ্যে জনসংখ্যার দিক দিয়ে বৃহত্তম, জনসমাজের বহুত্ব ও বিচিত্রতার পরিপ্রেক্ষিতে কঠিনতম। তবে লক্ষণীয়, এ বার সেই কঠিন কাজটির মধ্যে পদে পদে পরাজয়ের নিশানা। সেই ১৯৫১-৫২ সালে প্রথম নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেনের তত্ত্বাবধানের সময় থেকে দৃষ্টান্তমূলক যত্নসহকারে যে কাজ হয়ে আসছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আঠারোতম জাতীয় নির্বাচনটিতে বিস্তর অস্বস্তি ও হতাশার কারণ ঘটেছে। ভারতীয় গণতন্ত্র তার অসামান্য যাত্রাপথে পিছু হাঁটতে শুরু করেছে— নির্বাচন কমিশনের এ বারের আচরণে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত। অনেকগুলি ক্ষেত্রে কমিশনের বিবেচনা নিয়ে, নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সেই সব সন্দেহের উত্তর যা-ই হোক, তা যে তৈরি হওয়ার অবকাশ ঘটল, সেটাই অতীব দুর্ভাগ্যজনক।

Advertisement

নির্বাচনী প্রচারপর্বের সমাপনী ঘটনাটিই ধরা যাক। নির্বাচনকালীন আদর্শ আচরণবিধি মেনে চলার নীতিটি নির্বাচন কমিশনেরই প্রদত্ত, তার রূপরেখাও কমিশনের নিজেরই অঙ্কিত, ১৯৫১ সালের ‘রিপ্রেজ়েন্টেশন অব দ্য পিপল অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে। তদনুযায়ী, ভোটদান পর্বের ৪৮ ঘণ্টা আগে ‘সাইলেন্স পিরিয়ড’ বা নীরবতার পর্ব— সব প্রার্থীরাই তা মেনে চলেন, প্রচারের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। এ বার কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঠিক সেই ৪৮ ঘণ্টাকেই বেছে নিয়েছেন কন্যাকুমারীতে ধ্যানমণ্ডপম্-এ ধ্যানে বসার জন্য, এবং সারা দেশের সমস্ত প্রচারমাধ্যম তা প্রতি মূহূর্তে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। ব্যক্তিগত ধ্যান আর জনসমক্ষে ক্যামেরাপরিবৃত ধ্যান এক কথা নয়: দ্বিতীয়টি যদি প্রচারমাধ্যমে দেখানো হয়, আক্ষরিক অর্থেই তা ‘প্রচার’। তাঁর নিজের কেন্দ্র বারাণসীর ভোটাররাও কিন্তু তাঁকে ওই ৪৮ ঘণ্টা দেখে যাবেন, অন্য কাউকে নয়। নীরবতা পর্বে কী ভাবে এই কাজে কমিশন সম্মতি দিল? কংগ্রেসের রণদীপ সুরজেওয়ালা, অভিষেক সিংভি, সৈয়দ নাসির হোসেন থেকে বহু বিরোধী নেতা এই প্রশ্ন তুলেছেন, ফল হয়নি। প্রসঙ্গত, বিরোধী নেতারা এর আগে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর অন্যান্য দলচর নেতার মুখে সরাসরি সাম্প্রদায়িক প্রচারের বিরুদ্ধেও কমিশনের কাছে পদক্ষেপের আপিল জানিয়েছেন: তাতেও ফল হয়নি। কয়েক জন ‘তারকা প্রচারক’ বিষয়ে কমিশনকে সতর্ক করা হয়েছিল, যেমন, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এবং অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা। তাঁদের বিষয়ে কমিশন এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। বিপরীতে, কমিশনের সতর্কবার্তা পৌঁছেছে ওয়াইএসআরসিপি নেতা জগন্মোহন রেড্ডি, বিআরএস নেতা কে চন্দ্রশেখর রাও, বিজেপি নেতা ও প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, কংগ্রেস নেত্রী সুপ্রিয়া শ্রীনেত, রণদীপ সুরজেওয়ালার কাছে।

তালিকা থেকে স্পষ্ট, নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয় ভোটপ্রচারে উত্থাপিত হতে দেখে বিচলিত বোধ করেছে, কিন্তু সরাসরি বিদ্বেষ প্রচারে ভ্রুক্ষেপ করেনি। অথচ রাজনৈতিক প্রচারে তর্কবিতর্ক যেমন গণতন্ত্রের অধিকার, তেমন যে কোনও সম্প্রদায়েরও স্বাধীনতা প্রাপ্য, আক্রান্ত বোধ না করার স্বাধীনতা। নির্বাচন কমিশন সেই অধিকার ও স্বাধীনতা দানে ব্যর্থ। এর পর ভোটগণনা পর্ব ঠিক ভাবে সমাধা হবে কি না, তা নিয়েও রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজে এ বার অভূতপূর্ব উদ্বেগ। ফলত, শেষ পর্যন্ত ভোটের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, এ দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের পরিবেশটি হেরে গিয়েছে, এ সিদ্ধান্ত করাই চলে। সংবিধানের বিপরীতে হেঁটে সেই পরাজয় ঘটানোর দায় যে সব প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে, নির্বাচন কমিশন তার মধ্যে অন্যতম প্রধান।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement