বৎসর গড়ায়, দশকও; দুর্দশাচিত্রটি পাল্টায় না। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের জলাধারগুলি হইতে বিপুল পরিমাণ জল ছাড়ায় দুই বর্ধমান, বীরভূম, হুগলি, হাওড়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত। প্রাণহানি হইয়াছে, জমি, ফসল ও সম্পদ চরম ক্ষতিগ্রস্ত। অব্যাহত রাজ্যের অভিযোগও— কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন সংস্থা ডিভিসি প্রতি বর্ষায় ঝাড়খণ্ডের জলাধারগুলি হইতে জল ছাড়িয়া পশ্চিমবঙ্গকে ডুবাইয়া দেয়। ইহা তাহাদের বাৎসরিক নিয়ম হইয়া দাঁড়াইয়াছে, এবং এই কারণেই এই বন্যা ডিভিসি-কৃত, মনুষ্যকৃত। মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীকে ডিভিসি লইয়া এই অভিযোগই করিয়াছেন, এবং আশ্চর্যের কথা, প্রধানমন্ত্রীর দফতর হইতে করা টুইটেও ডিভিসি-র ‘জলাধার হইতে জল ছাড়ার দরুন বন্যা পরিস্থিতি’র কথা উল্লিখিত। মুখ্যমন্ত্রী ‘সার্বিক পরিকল্পনা’ দাবি করিয়া পরিস্থিতির পরিবর্তন চাহিতেছেন। বিরোধীরা বলিতেছেন, মুখ্যমন্ত্রীই পরিকল্পনা বানাইয়া কেন্দ্রকে দিন না কেন। সন্দেহ হয়, রাজনৈতিক বাদ-প্রতিবাদের পালা চলিবে, চলিবে না কোনও পরিকল্পনা গ্রহণ কিংবা রূপায়ণ।
১৯৪৮ সালে ডিভিসি-র নির্মাণে আমেরিকার টেনেসি ভ্যালি অথরিটি-র মডেল অনুসৃত হইয়াছিল। বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ, দামোদর নদী-উপত্যকা অঞ্চলের উন্নয়ন, সবই ছিল তাহার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, ডিভিসি-র পরিকল্পনায় গলদ ছিল, টেনেসি প্রকল্পের ‘আদলে’ গড়া হইলেও গাঠনিক দিক দিয়া অনেক কিছু বাদ পড়িয়াছিল। প্রতি বৎসর দক্ষিণবঙ্গের দুর্দশার কারণ বর্ষার অতিবৃষ্টি হইলেও, তাহা ঘনীভূত ও দীর্ঘায়িত হইবার একটি কারণ যে ডিভিসি-র গঠনগত ত্রুটি, তাহা লইয়া সন্দেহ নাই। অতিবর্ষায় জলাধারের জল বাড়িয়া যায়, ধারণক্ষমতার অধিক হইলে সেই জল ছাড়িতে হয়, তাহাতেই নদী উপচাইয়া বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। নিম্ন অববাহিকায় এই জলাধারগুলি যে ভাবে নির্মিত, তাহাতে তাহাদের পক্ষে জল ধরিয়া রাখা সম্ভব কি না তাহা লইয়াই বিস্তর প্রশ্ন আছে, তদুপরি নির্মিত জলাধারের কারণে নদীখাত উঁচু হইয়া বর্ষায় বন্যাশঙ্কা তীব্রতর হয়। রাজ্যের তরফে আগেও দাবি উঠিয়াছিল, ডিভিসি-র জলাধারগুলি ও সংলগ্ন পরিকাঠামোর সংস্কার অবিলম্বে করা হউক। জলাধারের ধারণক্ষমতা ১.২ লক্ষ একর-ফুট করিলে জল ছাড়িবার জেরে বাংলার জেলাগুলির এহেন দুর্দশা হইবে না। সেই কথা কেহ কানে তোলে নাই, কাজের কাজও কিছু হয় নাই।
ফল ভুগিতেছেন সাধারণ মানুষ। দশকের পর দশক জুড়িয়া প্রলম্বিত ট্র্যাজেডি। দক্ষিণবঙ্গের মানুষ ইহাকে এক প্রকার ভবিতব্য মানিয়া লইয়াছেন— বর্ষায় কিছু দিন অতিবর্ষণ হইবে, ডিভিসি-ও জল ছাড়িবে, জনজীবনও ভাসিবে, ডুবিবে। প্রশাসনের তরফে দুর্গত মানুষকে সরানো হইবে, ত্রাণ ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হইবে, কিন্তু এই সমস্তই কি সমাধান? যে দুর্দশার মূলে মানুষের ভুল, একটি বৃহৎ প্রকল্পের মূলগত গাঠনিক ত্রুটি, তাহার সংস্কারের কি সময় হয় নাই? কোন কর্তৃপক্ষ তাহা ভাবিবেন বা করিবেন তাহা পরের কথা, আসল কথাটি হইল, বৎসরের পর বৎসর রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মানুষের এই অসম্ভব জলযন্ত্রণা চলিতে পারে না। মনুষ্যসৃষ্ট এই অমানুষিক সঙ্কটের সমাধান মানুষের হাতেই অবিলম্বে হওয়া দরকার।