আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক-শিক্ষার্থীর নৃশংস ধর্ষণ-খুনের মামলায় একমাত্র ধৃত সঞ্জয় রায়কে অপরাধী সাব্যস্ত করে আমরণ কারাবাসের দণ্ডাদেশ দেওয়া হল। এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে শিয়ালদহ অতিরিক্ত দায়রা আদালতের বিচারপতি অনির্বাণ দাস মন্তব্য করলেন: তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিচার হওয়া উচিত, জনতার আবেগের ভিত্তিতে নয়। এই উক্তিটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। গত বছরের ৮-৯ অগস্ট সংঘটিত পৈশাচিক অপরাধটিকে কেন্দ্র করে জনতার আবেগ কেবল তার ব্যাপ্তি এবং গভীরতার দিক থেকে অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছয়নি, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে সেই আবেগ এক ঐতিহাসিক প্রভাব ফেলেছে। এই ঘটনা, এবং তার প্রেক্ষাপটে ও পরবর্তী অধ্যায়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের ভয়াবহ লক্ষণগুলি নাগরিক সমাজে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে, দীর্ঘ সময় ধরে অজস্র মানুষ লাগাতার ‘বিচার চাই’ দাবিতে সরব ও সক্রিয় হয়েছেন, সামাজিক আন্দোলনের চাপে প্রশাসনের শীর্ষস্থানাধিকারীরা আক্ষরিক অর্থে পথে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু সেই প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলনের তরঙ্গ থেকে বিচারের প্রক্রিয়াকে দূরে রাখতে না পারলে বিচারের পথ হারিয়ে যায়। এই সত্যটিকেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে মাননীয় বিচারপতির সতর্কবার্তা।
প্রবল আবেগে আলোড়িত এই সমাজে বার্তাটি জরুরি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক আবেগ যত সঙ্গতই হোক, আইনকে তার নিজস্ব পথেই চলতে হবে। আদালত আর জনতার আদালত এক নয়। এক বিরাট অংশের নাগরিকের মতে এই মামলায় অপরাধীর যথেষ্ট শাস্তি হল না, মৃত্যুদণ্ডই বিধেয় ছিল। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও স্বয়ং তেমন অভিমত জানিয়েছেন। তিনি নিজের আসনে বসে এমন ভাবে ‘ফাঁসি চাই’ রব তুলে যেতে পারেন কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যাবে। ‘আমাদের হাতে থাকলে অনেক আগেই মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করা যেত’— এই মন্তব্য যে তাঁর পক্ষে বিধেয় হয়নি, সে বিষয়ে কোনও প্রশ্নই থাকতে পারে না। অন্য দিকে, মৃত্যুদণ্ড না দেওয়ার অন্যতম প্রধান যুক্তি হিসাবে মাননীয় বিচারপতি বলেছেন, এই অপরাধকে ‘বিরলের মধ্যেও বিরলতম’ বলা যাবে না। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তর্ক থাকতে পারে, কিন্তু সেই তর্কও যুক্তিসাপেক্ষ। সরকারি হাসপাতালের ভিতরে চিকিৎসক-শিক্ষার্থীর এমন পরিণতি নিঃসন্দেহে বিরল, কিন্তু তাঁর ধর্ষণ-খুনের নির্দিষ্ট ঘটনাটি তার চরিত্রে— ‘বর্বর ও নিষ্ঠুরতম’ হলেও— বিরলতম বললে কিছুটা অত্যুক্তি হতে পারে। মৃত্যুদণ্ড আদৌ বিধেয় কি না, সে-তর্ক সরিয়ে রাখলেও এ-প্রসঙ্গে আরও এক বার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, এই দণ্ডের প্রয়োগে যথেষ্ট সতর্ক থাকা জরুরি। মামলার ফল নিয়ে বিভিন্ন মত থাকতেই পারে, তবে সেই মতানৈক্য যুক্তি দিয়েই যাচাই করা যায়, আবেগ দিয়ে নয়।
কিন্তু জনতার আদালতে যে প্রশ্ন উঠেছে, তাকেও প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হবে। মাননীয় বিচারক বলেছেন, তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিচার হওয়া উচিত। তথ্যপ্রমাণ সরবরাহের দায়িত্ব কিন্তু প্রশাসনের। প্রশাসন কি সেই দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালন করছে? আর জি করের ঘটনায় রাজ্য সরকার এবং তার স্বাস্থ্য প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে অজস্র প্রশ্ন আছে, যার সদুত্তর মেলেনি। বিশেষত, সংশ্লিষ্ট তথ্যপ্রমাণ লোপ করার বা অভিযুক্ত ক্ষমতাবানদের আড়াল করার (এবং ক্ষেত্রবিশেষে ‘পুরস্কৃত’ করার) যে সব অভিযোগ উঠেছে, তার নৈতিক দায় প্রশাসনের কর্ণধারদের নিতেই হবে। ‘ফাঁসি চাই’ বলে পাড়া মাথায় করলে সেই দায় থেকে রেহাই মেলে না। অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তের হালও নাগরিকদের যথেষ্ট ভরসা দিতে পারেনি, বরং এই আশঙ্কাই বেড়েছে যে, সিবিআই নামক পর্বতটি মূষিক প্রসব করেই ক্ষান্ত হবে। আদালতের রায়ের পরে জনতার আদালতে এই প্রশ্নগুলির জবাবদিহি করতে হবে শাসকদের। কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই স্তরের শাসকদেরই।