তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইপ এর্ডোয়ান। —ফাইল চিত্র।
তা হলে রিচেপ এর্ডোয়ানই জিতলেন। দুনিয়াময় শোনা যাচ্ছিল, এর্ডোয়ান এ বার বিরোধীদের হাতে পর্যুদস্ত হতে চলেছেন, কিন্তু তেমন কিছু ঘটল না। এখন যে দেশের নাম পাল্টিয়ে তুর্কি বা টার্কি থেকে ‘তুর্কিয়ে’, সেখানে আরও পাঁচ বছর তাঁরই শাসন বলবৎ রইল। এ বারের জয়ের ফলে তিনি হলেন সে দেশের দীর্ঘতম সময়ের শাসকব্যক্তি— অটোমান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটিয়ে যে তুরস্ক একশতাধিক বছর আগে জন্ম নিয়েছিল, তার প্রতিষ্ঠাতা-নেতা কামাল আতাতুর্কের পর এ দিক দিয়ে এর্ডোয়ানই পাচ্ছেন দ্বিতীয় স্থান। দক্ষিণপন্থী স্বৈরশাসকরা দুনিয়াময় নিশ্চিন্ত ও প্রসন্ন— এর্ডোয়ানের সাফল্যে অনেক দেশেরই রক্ষণশীল শক্তিগুলি হাঁপ ছেড়েছে। বাহান্ন শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছেন তিনি, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী পেয়েছেন প্রায় আটচল্লিশ শতাংশ ভোট। এর থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক, লিবারাল-মনস্ক গণতন্ত্রকামী স্বৈরতন্ত্র-বিরোধীদের জোট মোটের উপর ভালই ফল করেছে, প্রায় শাসকের ঘাড়ের কাছেই চলে এসেছিলেন তাঁরা। তবে শেষ পর্যন্ত যে-হেতু বাকি পাঁচ শতাংশ ভোট গিয়েছে অতি-দক্ষিণপন্থী তৃতীয় প্রার্থীর কাছে, যিনি আবার ভোট-পরবর্তী বোঝাপড়ায় এর্ডোয়ানকে সমর্থন করে তাঁর হাত শক্ত করেছেন— তুর্কিয়ে এবং বৃহত্তর ‘গ্লোবাল সাউথ’ বা দক্ষিণ-বিশ্বের উদারবাদী গণতন্ত্রকামী শক্তিগুলির হতাশ্বাস বোধ করা ছাড়া হয়তো গতি নেই।
আশ্বাসের বাতায়ন অবশ্য খোলা রাখাও যায়। প্রায় আটচল্লিশ শতাংশ মানুষ যে তাঁদের দেশের ‘স্ট্রংম্যান’ নেতাকে পছন্দ করছেন না, এই কি কম কথা। নির্বাচনের ফলে যে রাজনৈতিক পার্থক্য তৈরি হল, সামাজিক তলে তাকে জিইয়ে রাখা কোনও মতেই অসম্ভব নয়। সমাজ যে কতটাই দ্বিধাবিভক্ত, তা পরিষ্কার হওয়ায় নবপর্যায়ের প্রেসিডেন্ট এর্ডোয়ানও নিশ্চয় খুব স্বস্তিতে থাকবেন বলে মনে হয় না। গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির মনে রাখা জরুরি, রাজনৈতিক পরাজয় আর সামাজিক সুযোগ তৈরি একই সঙ্গে ঘটা সম্ভব। তুর্কিয়ে-তে তা-ই ঘটেছে বলে ইঙ্গিত।
ইতিমধ্যে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ভেসে এসেছে অভিনন্দনবার্তা। নেটো-র বার্তা এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তুর্কিয়ে এখন নেটো-র সদস্য, কিন্তু তা সত্ত্বেও রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে যে সব নিন্দাবার্তা প্রচার ও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল নেটো, কোনওটিতেই স্বাক্ষর করেনি এর্ডোয়ানের দেশ। ফলে, এ বারে তাঁর পুনরাগমনে নেটোর কী প্রতিক্রিয়া, দেখার জন্য উদ্গ্রীব ছিলেন অনেকেই। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অবশ্য সবটা ধরা পড়ে না। একই ভাবে দিল্লির দিক থেকেও স্বাগত প্রতিক্রিয়া না দিয়ে উপায় ছিল না— এ কথা হজম করে যে গত কয়েক বছর কট্টর ইসলামের ধারক-বাহক-প্রস্তাবক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক প্রেসিডেন্ট এর্ডোয়ান পাকিস্তানের বিশেষ ঘনিষ্ঠ। কাশ্মীর প্রশ্নে একাধিক বার তিনি সরাসরি ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। তবে এক ভোটে ‘শীত’ পালায় না। তুর্কিয়ে যে অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ক্রমশ নিমজ্জমান, যে কারণে প্রেসিডেন্টের প্রতি দেশের জনসমাজের এক বিরাট অংশ ক্ষুব্ধ, এমনকি ক্ষিপ্ত— সেই সঙ্কটটি ভারতের পক্ষে একটা ‘সুযোগ’ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তুর্কিয়ে-কে সহায়তা দানের সুযোগ। এবং সেই সূত্রে দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়া শক্তপোক্ত করার সুযোগ।