নির্মলা সীতারামন। —ফাইল চিত্র।
রাজনীতিই হয়তো শেষ কথাটি বলবে— কিন্তু, শেষের আগের কয়েকটি কথা যদি অন্যরা বলার সুযোগ না পায়, তা হলে মুশকিল। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই গত কাল লেখা হয়েছে, বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন যে ভঙ্গিতে বিহার ও অন্ধ্রপ্রদেশের ঝুলি ভরে দিলেন ঘোষণায়-ঘোষণায়, তাতে অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা নেই— থাকার কথাও নয়— আছে কেবল জোট-রাজনীতির বাধ্যবাধকতা। রাজনীতিকে সেই জায়গাটি ছাড়ার জন্য কোপ পড়ল যার ঘাড়ে, তার নাম অর্থনৈতিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তা। বাজেট-বক্তৃতায় পশ্চিমবঙ্গের নামটি উচ্চারিত হয়েছে সাকুল্যে এক বার। অমৃতসর থেকে কলকাতা পর্যন্ত শিল্প করিডরটিও এই বাজেটে এসে রাজনীতির জটে পড়ে বিহারের গয়াতেই আটকে গেল। পাহাড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণের তহবিলের টাকাও পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছল না। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে যে, কেন্দ্রীয় সরকার কি সচেতন ভাবেই পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চনা করল? এটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কি না, সে জল্পনা অবান্তর। তবে, উত্তর-পূর্ব ভারত উন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার যে ভাবে উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের স্বার্থে তাকে (পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে) উত্তর-পূর্ব ভারতের অংশ হিসাবে গণ্য করার পক্ষে সওয়াল করেছেন, তাতে আশঙ্কা হতে পারে যে, এই বাজেটে পশ্চিমবঙ্গের বঞ্চনাটি নেহাত সমাপতন নয়, তার পিছনে গভীরতর কোনও নকশা রয়েছে। রাজনীতি এসে উন্নয়নের অর্থনীতির যুক্তিকে তিস্তার জলে ভাসিয়ে দিলে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
গত এক দশকের অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট যে, বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলিকে চাপে রাখার সুযোগ হাতছাড়া করতে কেন্দ্রীয় সরকার নারাজ। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় আর্থিক কাঠামো এমনই যে, কেন্দ্রীয় রাজস্ব তহবিলের উপর নির্ভর না করে রাজ্যগুলির উপায় নেই। ফলে, বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলির কর্তব্য কেন্দ্রের উপরে নিরন্তর চাপ সৃষ্টি করে চলা, আর সেই চাপের একটি পরিসর হল নীতি আয়োগ। ফলে, বাজেটের পরেই নীতি আয়োগের বৈঠকে যখন অন্য বিরোধী দলগুলি যোগ দিতে অসম্মত হল, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সেই বৈঠকে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পশ্চিমবঙ্গের ন্যায্য পাওনা আদায় করার সেটিই পথ। শেষ পর্যন্ত তা-ও অবশ্য রাজনীতির বেনো জলে ভেসে গেল। মাঝপথেই বৈঠক থেকে বেরিয়ে এলেন ক্ষুব্ধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— অভিযোগ করলেন, বিজেপি-শাসিত বা এনডিএ শরিক-শাসিত রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের বলার জন্য যত সময় দেওয়া হয়েছিল, তাঁকে সেই সময় দেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন থেকে নীতি আয়োগের সিইও বিভিআর সুব্রহ্মণ্যম মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে জানিয়েছেন যে, তাঁর সঙ্গে কোনও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়নি। সেই বৈঠকে কী হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, অর্থনৈতিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার আরও একটি সম্ভাবনা বিনষ্ট হল রাজনীতির কল্যাণে।
পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের জন্য যে বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন, তা অনস্বীকার্য। সেই মনোযোগ আদায় করা রাজ্য সরকারের কর্তব্য। কর্মসংস্থান যোজনা-সহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যে টাকা না-আসার অভিযোগ দীর্ঘ দিন ধরেই করছে রাজ্য সরকার। সেই টাকা আদায় করার জন্য চাপ বজায় রাখতে হবে। এই রাজ্যের জন্য বিশেষত পরিকাঠামো খাতে নতুন প্রকল্প তৈরির জন্য চাপ দিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। কোথায় কোন ধরনের প্রকল্প করা সম্ভব, তার নকশা কী হতে পারে ইত্যাদি প্রস্তাব রচনা করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তা পেশ করা হোক। এবং, সাধারণ মানুষকে এই উদ্যোগের কথা জানানো হোক। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যকে বঞ্চনা করলে তার রাজনৈতিক দায় যাতে কেন্দ্রের উপরেই বর্তায়, তা নিশ্চিত করার কাজ রাজনীতিরই। রাজনীতিকেই শেষ অবধি উন্নয়নের বাহন হতে হবে।