নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জনক নিলস বোরের মত ছিল, গবেষণা এগিয়ে চলে এক শবযাত্রা থেকে আর এক শবযাত্রায়। সমস্যা উদ্ভূত হলে, তার সমাধানেই বিজ্ঞান এগোয়। সাধারণ মানুষ যেখানে অভ্যস্ত নিরুপদ্রব জীবনে, সেখানে বোর উৎফুল্ল হতেন সমস্যার উদ্রেক হলে। অনুজ বিজ্ঞানীরা সমস্যায় পড়লে যখন চিন্তাগ্রস্ত হতেন, তখন তিনি তাঁদের উৎসাহ জুগিয়ে বলতেন, বিজ্ঞানে সমস্যা মানে নতুন তত্ত্ব আবিষ্কারের ক্লু। পুরনো থিয়োরি বিসর্জন দিয়ে এ বার নতুন থিয়োরি আমদানি করতে হবে। গবেষণায় শবযাত্রা, অতএব, সুখকর। কণারাজ্যে এখন হয়তো তেমনই এক মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত। পদার্থ বিজ্ঞানের মহাতত্ত্ব— যার নাম ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’— তা কি এ বার জলাঞ্জলি দিতে হবে? ১৯৭০-এর দশক থেকে বহু বিজ্ঞানীর অবদানে সমৃদ্ধ ওই স্ট্যান্ডার্ড মডেল। ওই তত্ত্ব এত দিন পর্যন্ত কণারাজ্যের সমস্ত পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যা করেছে। যে তত্ত্ব এত শক্তিশালী, তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না সামান্য একটা কণার ভর ব্যাখ্যা করা। ‘ডব্লিউ’ নামধারী ওই কণার ভর ব্যাখ্যা করতে পারছে না স্ট্যান্ডার্ড মডেল। সায়েন্স পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ওই রিপোর্ট।
আমেরিকার ফের্মিল্যাব গবেষণাগারে ২০১২ সালের এক গবেষণার প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে নতুন করে বিশ্লেষণ করা হয়েছে কণাটির ভর। দেখা গেছে, ডব্লিউ কণার ভর স্ট্যান্ডার্ড মডেল অনুযায়ী যা হওয়া উচিত, তার চেয়ে ০.০৯ শতাংশ বেশি ভারী। বিজ্ঞানের জগতে তা বিরাট চ্যুতি। কণা বিজ্ঞানী এবং সুইৎজ়ারল্যান্ডে জ়ুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফোরেনসিয়া কানেলি বলেছেন, ডব্লিউ কণার এই বেশি ভর এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ। স্ট্যান্ডার্ড মডেল পরিবর্তন করা উচিত। আর যিনি ফের্মিল্যাবে ওই পরীক্ষার নেতৃত্বে ছিলেন, সেই আশুতোষ কোতোয়াল বলেছেন, পরীক্ষার ফলাফল দেখাচ্ছে, প্রকৃতির ভান্ডারে কী জমা আছে। ডব্লিউ কণার ভর মোটামুটি ভাবে ৮৫টি প্রোটন কণার সমান। কিন্তু ডব্লিউ কণার ভর চুলচেরা ভাবে মাপতে গেলে বিপত্তি।
ডব্লিউ কণা ইলেকট্রোউইক ফোর্সের ক্ষেত্রে সাহায্যকারী ভূমিকা পালন করে। বিশ্বে তিনটি ফোর্স বা বল ক্রিয়াশীল— গ্র্যাভিটি, স্ট্রং, এবং ইলেকট্রোউইক ফোর্স। বল তিন রকমের কেন? এই প্রশ্নে একদা পীড়িত হয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইনও। তাই তাঁর জীবৎকালে গ্র্যাভিটি এবং ইলেকট্রোম্যাগনেটিজ়ম কেবল জানা থাকায়, তিনি ওই ফোর্সের মিলন ঘটানোর প্রচুর চেষ্টা করেন, এবং ব্যর্থ হন। ১৯৭৯ সালে তিন বিজ্ঞানী— স্টিভেন ওয়েনবার্গ, আবদুস সালাম এবং শেলডন গ্লাসো— ইলেকট্রোম্যাগনেটিজ়ম এবং উইক ফোর্সের মিলন ঘটানোর জন্য নোবেল প্রাইজ় পান। সে মিলন ঘটাতে গিয়ে ওঁরা ডব্লিউ কণার ভবিষ্যদ্বাণী করেন। ১৯৮৩ সালে ওই কণা আবিষ্কার করেন দুই বিজ্ঞানী কারলো রুবিয়া এবং সাইমন ভ্যান ডার মিয়ার। এই সাফল্যের জন্য রুবিয়া এবং ভ্যান ডার মিয়ার নোবেল প্রাইজ় পান পরের বছরই। এখন প্রশ্ন এই যে, ইলেকট্রোম্যাগনেটিজ়ম বা ইলেকট্রোউইক ফোর্স, যা দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের উপরে, তার কী হবে? কণা পদার্থবিজ্ঞান এক জটিল সন্ধিক্ষণে আজ দাঁড়িয়ে।