ফি বর্ষায় কোনও এক সময় অতি প্রবল বর্ষণ হইবে, আর দিন কয়েকের জন্য প্লাবিত হইয়া যাইবে কলিকাতা নগরী— এই দুর্ভাগ্য চক্রাকারে ফিরিয়া আসে। প্রায় কোনও বৎসরই তাহার ব্যত্যয় ঘটে না। এই বার জুলাইয়ের শেষে ও অগস্টের শুরুতে একাধিক দিন বৃষ্টির জলে নিমজ্জিত থাকিল শহরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। যদিও এই বর্ষণটি সমগ্র দশকের নিরিখে অভূতপূর্ব, কলিকাতা ব্যতীতও ভাসিয়া গিয়াছে দক্ষিণবঙ্গের অনেকগুলি জেলার শহর ও গ্রাম, তবু রাজধানী শহরের নিকাশি ব্যবস্থার কার্যকারিতা লইয়া চিরন্তন প্রশ্নটি তুলিতেই হয়। এই প্রশ্ন বহু পুরাতন, প্রতি বৎসরই ঘুরিয়া আসে, কিন্তু অবস্থার উন্নতি যে হেতু হয় না, অতএব প্রশ্নটিও করিয়া চলা ছাড়া গত্যন্তর নাই। বৃষ্টি হইবে, জল জমিয়া যাইবে, নাগরিকদের ভোগান্তি হইবে, এবং তাহার পর ফের পরের বর্ষণের আশঙ্কায় উৎকণ্ঠিত হইয়া থাকিতে হইবে— ইহা কোনও সুস্থ নগর পরিকল্পনার অংশ হইতে পারে না। নিকাশি ব্যবস্থার প্রতি যথাশীঘ্র নজর দেওয়া অত্যাবশ্যক।
তিন শতক ধরিয়াই কলিকাতার পুরাতন খাল ব্যবস্থা তাহার নিকাশির ভিত্তিস্বরূপ। কিন্তু বহু দশক যাবৎ তাহা পলির অধঃক্ষেপে বোঝাই, ভারী বর্ষণ হইলে খালগুলি স্বভাবতই উপচাইয়া যায়। পাড়ায় পাড়ায় অসংখ্য পিট বা ম্যানহোল সম্পূর্ণ বুজিয়া যাইবার ফলে পাম্পিং স্টেশনগুলিতে জল পৌঁছাইতে বহু বিলম্ব হয়। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নগর প্রশাসনের অদক্ষতা এবং প্লাস্টিকের প্রাবল্য সমস্যা বাড়াইয়াছে। প্রতি বৎসর কলিকাতা ভাসিয়া যাইবার পশ্চাতে এই কারণগুলিই প্রধান। প্রশাসনিক ব্যর্থতা তো বটেই— অক্ষমণীয় ব্যর্থতা— কিন্তু ভূগোলও শহর কলিকাতাকে মারিয়াছে। যে শহরের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ হইতে মাত্র ২০ ফুট, তাহার ভবিতব্য এমনই, বিশেষত অতি বর্ষণের সময়টি যদি হুগলি নদীর কটালের সহিত মিলিয়া যায়। এমতাবস্থায় প্রশাসনকে কেবল গয়ংগচ্ছ ভাব দূর করিলেই চলিবে না, অতি সক্রিয় হইতে হইবে। এই বার যেমন চারশতটি পাম্প বসাইবার পরেও জল নামে নাই; শুনা গিয়াছে, ঠিকাদারেরা যথাযথ ভাবে যন্ত্রগুলি চালু করেন নাই। এই রূপ বচসা চালাইবার বিলাসিতা কলিকাতা অন্তত করিতে পারে না।
অধিক দুশ্চিন্তার কথা, এই বর্ষণে শহরতলি এবং বিধাননগর, নিউ টাউন প্রভৃতি উপনগরীও ভাসিয়াছে। কলিকাতার নিকাশি ব্যবস্থা নাহয় প্রাগাধুনিক যুগে নির্মিত— তাহাকে ঢালিয়া সাজানো কঠিন— কিন্তু হালে প্রতিষ্ঠিত আধুনিক শহরগুলিতে পরিকল্পনা যথাযথ হয় নাই কেন? প্রশ্নটি গুরুতর, কেননা ১৯৩০-এর দশক হইতে শহর যখন পূর্বাভিমুখে বৃদ্ধি পাইতে শুরু করিল, তাহার পর একাধিক বার উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিকাশি পরিকল্পনাকে অবহেলা করিবার অভিযোগ উঠিয়াছে। যে অঞ্চল নিজেই কলিকাতার অতিরিক্ত জল ধারণ করিত, সেইখানে বসতি স্থাপন করিবার কালে নিকাশির বিষয়টিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন ছিল। তাহা হয় নাই। কলিকাতার পরিপ্রেক্ষিত তো বিচার করা হয়ই নাই, শহরতলি ও নূতন শহরগুলিতেও জল বাহির করিবার বা জল ধরিয়া রাখিবার ব্যবস্থার কথা ভাবা হয় নাই। আপনারই অবিবেচনা ও পরিকল্পনাহীনতায় বার বার নিমজ্জিত হইয়া থাকে কলিকাতা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল।