পাট শিল্পের পরিত্রাতার ভূমিকায় বিজেপি নেতা অর্জুন সিংহ, দেখে চমৎকৃত রাজ্যবাসী। কাঁচা পাটের সরকারি দাম বাড়ানোর দাবিতে তিনি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছেন, কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী পীযূষ গয়ালের সঙ্গে বৈঠকের পরেও আশ্বাসের ‘ললিপপ’-এ সন্তুষ্ট হননি। বঙ্গ-বিজেপি অস্বস্তিতে। আক্ষেপ, এর ফলে অর্জুনের দলবদলের সম্ভাবনা নিয়ে যত জল্পনা হচ্ছে, বন্ধ চটকল খোলার সম্ভাবনা নিয়ে তত কথা হয়নি। তবু মন্দের ভাল, পাটচাষি, চটকল শ্রমিক আজ দলীয় রাজনীতির দ্বন্দ্বের বিষয় হয়েছে। তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনও দাবি করেছে, কেন্দ্রীয় সরকার কাঁচা পাটের সর্বোচ্চ দাম (সাড়ে ছয় হাজার টাকা কুইন্টাল) বেঁধে দেওয়ার নীতির জন্যই ধ্বংস হচ্ছে বাংলার পাট শিল্প। দাম বাড়ানোর সপক্ষে আন্দোলনকারীদের যুক্তি, গত কয়েক বছর উপর্যুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে পাট চাষে ক্ষতি, এবং পাট চাষের এলাকার সঙ্কোচনের ফলে উৎপাদনে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে, সেচ-সহ নানা খাতে উৎপাদনের খরচ বেড়েছে, পাটের মানও পড়েছে। এখন ভাল মানের পাটের বাজারদর সরকার-নির্ধারিত দামের চাইতে বেশি। অথচ, চটের বস্তার দাম বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় সরকারই চটের বস্তার প্রধান ক্রেতা। চড়া দরে পাট কিনে সরকারি মূল্যে বস্তা বিক্রি করতে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে চটকলগুলি। অতএব কেন্দ্রকে দামের সর্বোচ্চ সীমা তুলে দিয়ে বাজারদরে পাট কেনার অনুমোদন দিতে হবে, নইলে বাড়াতে হবে বস্তার দাম।
অন্য দিকে, জুট কমিশনের অভিযোগ, বেআইনি মজুতদারির কারণেই বাজারে কাঁচা পাটের কৃত্রিম অভাব তৈরি হচ্ছে, দাম বাড়ছে। পাট কিংবা বস্তার দাম বাড়িয়ে দিলে তা হবে কার্যত বেআইনি মজুতদারদের ভর্তুকি দান। কেন্দ্রীয় সরকার কেন সেই দায় বহন করবে? চটকল মালিকদের সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন’ এবং কাঁচা পাট ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘জুট বেলার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রতিনিধিরাও অভিযোগ করেছেন, এক শ্রেণির ব্যবসায়ী চাষিদের থেকে কাঁচা পাট কিনে মজুত করছে দাম বাড়ার আশায়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ ভাবে কাঁচা পাট আমদানি চলছে। সঙ্কট আরও জটিল হয়েছে এক শ্রেণির চটকল মালিক কালোবাজারিতে জড়িত থাকার জন্য।
পাট শিল্পের প্রতি দীর্ঘ দিন রাজনৈতিক অবহেলা যে সঙ্কট তৈরি করেছে, এখন দলীয় রাজনীতিই তার প্রতিকার দাবি করছে। তবু সুযোগ যখন এসেছে, তার সদ্ব্যবহার করা চাই। প্রায় চার লক্ষ শ্রমিক এবং চল্লিশ লক্ষ চাষি পাট শিল্পের উপর নির্ভরশীল। পরিবেশ সুরক্ষার জন্যেও প্লাস্টিকের বস্তা বর্জন করা প্রয়োজন। চাল-গম প্যাকেটবন্দি করতে কেন্দ্রকে যথেষ্ট চটের বস্তা সরবরাহ করা দরকার। দেশ-বিদেশে পাটজাত সামগ্রীর কদরও বেড়েছে। অতএব পাট শিল্প বাঁচাতে হবে, কিন্তু তার জন্য অদক্ষ, দুর্নীতিগ্রস্ত এক ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখা চলে না। পাটের মজুতদারি ও কালোবাজারি বন্ধ করা, পাট চাষিদের উৎসাহ দান, ন্যায্য মূল্যে পাট ক্রয়ের ব্যবস্থা, চটকল শ্রমিকদের যথাযথ সুরক্ষা দান, চটকলগুলির মালিকানায় স্বচ্ছতা, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং দক্ষ পরিচালনা— এই সবই প্রয়োজন। কর্তব্য অজানা নয়, ঘাটতি রাজনৈতিক সদিচ্ছায়। তার বদল হবে কি?