Pragya Samal

ব্যতিক্রমী

জার্মান নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখটের সুবিদিত কথাটিকে ঈষৎ সংশোধন করে বলা যেতে পারে: দুর্ভাগা সেই দেশ, যার এমন ব্যতিক্রমের প্রয়োজন হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৪ ০৮:৫৫
Share:

প্রজ্ঞা সামালকে সংবর্ধনা বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের। ছবি পিটিআই।

সংবাদের পাঠক ও দর্শকরা অনেকেই কয়েক দিন আগে ছবিটি দেখেছেন এবং আনন্দ পেয়েছেন। নিছক উল্লাস বা ক্ষণিকের স্ফূর্তি নয়, এক যথার্থ ও গভীর আনন্দ, যা এই গ্লানিময় নিত্য বর্তমানের গণ্ডি অতিক্রম করে অন্যতর ভুবনের স্বাদ এনে দেয়। সেই আনন্দের উৎসে থাকে এই গভীর সত্য যে— কল্পনা নয়, স্বপ্ন নয়, বাস্তবের জমিতেই সেই ভুবন গড়ে তোলা যায়; কঠিন বাস্তবের বিস্তর বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে চলা যায় আপাত-অসম্ভব ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথে। যে তরুণীর সাম্প্রতিক ছবি এমন একটি উত্তরণের কাহিনিকে উন্মোচিত করেছে, তাঁর নাম প্রজ্ঞা। তাঁর বাবা ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের কর্মী, তিনি সেখানে পাচকের কাজ করেন। আইনের ছাত্রী প্রজ্ঞা অনেক পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশোনা করে স্নাতক হয়েছেন, অতঃপর আমেরিকার দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে আইন পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। এই কৃতিত্বের জন্য তাঁকে অভিবাদন জানিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা। বুধবার প্রধান বিচারপতি ও তাঁর সহ-বিচারকরা সমবেত ভাবে প্রজ্ঞা ও তাঁর বাবা-মাকে একটি অনুষ্ঠানে অভিনন্দিত করেন। সেই অনুষ্ঠানের ছবি বহুলপ্রচারিত হয়েছে। সাধারণ ঘরের এক তরুণ নাগরিকের এই ব্যতিক্রমী সাফল্য অকুণ্ঠ প্রশংসার দাবি রাখে, সে-কথা কেউই অস্বীকার করবেন না।

Advertisement

এবং অকুণ্ঠ সততার সঙ্গে স্বীকার করা দরকার যে, এমন সাফল্য ব্যতিক্রমী না-হওয়াই কাম্য ছিল। জার্মান নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখটের সুবিদিত কথাটিকে ঈষৎ সংশোধন করে বলা যেতে পারে: দুর্ভাগা সেই দেশ, যার এমন ব্যতিক্রমের প্রয়োজন হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিশেষ ভাবে স্মরণীয় প্রধান বিচারপতির উক্তিটি। প্রজ্ঞার কৃতির প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “কেউ যদি যথেষ্ট পরিশ্রম করে, সাফল্য মিলবেই। কোনও পরিশ্রমী শিক্ষার্থী যেন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, এটা নিশ্চিত করা আমাদের সকলের কর্তব্য।” এই বাক্য দু’টিতে যুগপৎ প্রত্যয় এবং প্রত্যাশার সুর ধ্বনিত হয়েছে: পরিশ্রমী শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ানোর কর্তব্য সকলে পালন করবে, এই প্রত্যাশা যদি পূর্ণ হয়, তবে পরিশ্রমের সাফল্য নিশ্চিত হওয়ার প্রত্যয়টিও সার্থক হবে। এই উক্তির প্রকৃত গুরুত্ব ও মূল্য এইখানেই যে, তা সত্য হয়ে উঠলে তখন আর এমন বিশেষ কৃতিত্বের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হবে না, অগণন সাধারণ পরিবার থেকে অগণন প্রজ্ঞা উঠে আসবেন এবং এগিয়ে যাবেন। সকলের নাগালে থাকবে নিজের জীবন গড়ে তোলার সমান সুযোগ, পরিশ্রম করলেই সাফল্য মিলবে, অস্বাভাবিক ব্যতিক্রমই হয়ে উঠবে স্বাভাবিক নিয়ম। মাননীয় বিচারপতিও নিশ্চয়ই তেমন একটি ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষা করেন।

সকলের নাগালে সমান সুযোগ থাকার বাস্তব কেন আজও, দেশ স্বাধীন হওয়ার পঁচাত্তর বছর পরেও, ভবিষ্যতের— সুদূর থেকে সুদূরতর ভবিষ্যতের— আকাঙ্ক্ষা থেকে গেল, কেন তা নিত্য বর্তমান হয়ে উঠল না? এই প্রশ্নের গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য কোনও বিশেষ মতাদর্শের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন নেই, তা উঠে আসে একটি যথার্থ সভ্যতার স্বাভাবিক এবং মৌলিক দাবি হিসাবেই। অর্থনীতি কী ভাবে চলবে, সেখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে, বাজারের স্বাধীনতা কতখানি অবাধ হবে, সেই প্রশ্নের যে উত্তরই সাব্যস্ত হোক না কেন, সমস্ত নাগরিকের জীবনযাপনের ন্যূনতম সংসাধন ও পরিবেশ সরবরাহ করার কাজটি অবশ্যকর্তব্য। শিক্ষার সুযোগ তার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। বস্তুত, একটি সমাজে নাগরিকদের সামনে আপন পরিমণ্ডল তথা উত্তরাধিকারের পিছুটানকে অস্বীকার করে এগিয়ে যাওয়ার যে কার্যকর সুযোগকে ‘মোবিলিটি’ বা সচলতা নামে অভিহিত করা হয় এবং যে সচলতা সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের এক অনন্য চরিত্রলক্ষণ হিসাবে বন্দিত হয়ে থাকে, সুশিক্ষার সর্বজনীন সুযোগ তার অন্যতম প্রধান শর্ত। প্রজ্ঞার দৃষ্টান্তটিও সেই সত্যকে সুস্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত করে। এবং এমন দৃষ্টান্তের কষ্টিপাথরে যাচাই করলেই অনায়াসে ধরা পড়ে যে, এই দেশে শিক্ষার সুযোগ অধিকাংশ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়নি। তার থেকেও বড় কথা, গত দুই বা তিন দশকে, সেই সুযোগের অসাম্য বহুগুণ বেড়েছে। শিক্ষা, বিশেষত উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চতর স্তরের শিক্ষা, সামাজিক সাম্য প্রসারের বদলে অসাম্যকেই উত্তরোত্তর জোরদার করেছে। বিরল ব্যতিক্রমের উজ্জ্বল দৃশ্যগুলি দেখে পরিশ্রমী তরুণতরুণীদের ব্যক্তিগত সাফল্যকে অকুণ্ঠ অভিবাদন জানানোর সময় মনে রাখতে হবে যে, তার চার পাশে বিরাজ করছে পরিব্যাপ্ত অন্ধকার।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement