পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মতে, নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ আচরণ করলে (এবং কংগ্রেসের রাজ্য নেতৃত্ব তাঁর প্রস্তাব মেনে দু’টি আসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে) তাঁর দল লোকসভা নির্বাচনে আরও ভাল করত। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, রাজ্যের শাসক দলের দমনপীড়ন ও পুলিশ প্রশাসনের অন্যায় পক্ষপাতিত্বের কারণে তাঁর দল ভোটে ভাল ফল করতে পারেনি। কারও বক্তব্যকেই সম্পূর্ণ অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না; নরেন্দ্র মোদী জমানার নির্বাচন কমিশন এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল বা প্রশাসন, কেউই সদাচারের জন্য প্রসিদ্ধ নয়। কিন্তু রাজ্যের বড় ছবিটা তাতে পাল্টায় না। সেই ছবির দু’টি প্রধান বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্ট। প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী রাজনীতি এখনও সরাসরি দুই দলের লড়াই: তৃণমূল কংগ্রেস এবং ভারতীয় জনতা পার্টির সেই লড়াইয়ে অন্যান্য দল, এমনকি জোটবদ্ধ সিপিআইএম-কংগ্রেসও গৌণ, অনেক ক্ষেত্রেই অকিঞ্চিৎকর। দ্বিতীয়ত, সেই দ্বিমুখী প্রতিযোগিতায় গত বিধানসভা ভোটের মতোই এই লোকসভা নির্বাচনেও তৃণমূল কংগ্রেসের সাফল্য বিপুল ও অবিসংবাদিত। ২০১৯ সালে বিজেপি লোকসভার ১৮টি আসনে জয়ী হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্গে বড় রকমের ক্ষয় ধরিয়েছিল, কিন্তু এ-বার তাদের আসনসংখ্যা ১২’য় নেমেছে, এবং সেই আসনগুলি কয়েকটি অঞ্চলে সীমিত। নরেন্দ্র মোদীর পশ্চিমবঙ্গ জয়ের স্বপ্ন আপাতত স্বপ্নই থেকে গেল।
অথচ স্বপ্নপূরণের জন্য লাফঝাঁপ তাঁরা কম করেননি। কেবল রাজ্য স্তরের নেতারা নন, প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সমেত রাজধানীর নায়কনায়িকারাও ক্রমাগত রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে এসে রকমারি হুঙ্কার দিয়েছেন, সেই হুঙ্কার প্রায় নিয়ম করেই সৌজন্যের সীমা অতিক্রম করেছে, আবার তাঁদের জয়ী করলে পশ্চিমবঙ্গকে সোনার বাংলা করে দেওয়ার পুরনো এবং বহুলপরিচিত প্রতিশ্রুতি বিতরণেও তাঁরা কার্পণ্য করেননি। তদুপরি, তাঁদের প্রচারে যথারীতি বড় ভূমিকা নিয়েছে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের প্রচ্ছন্ন অথবা নিরাবরণ তৎপরতা, নাগরিকত্ব আইন নামক বস্তুটি যার অন্যতম নজির। কিন্তু, স্পষ্টতই, এই কৌশলগুলি কাজ করেনি। বরং, তাঁদের অনেকের আগ্রাসী, অশোভন এবং বিভাজনী রাজনীতির ভাষা ও ভঙ্গি বঙ্গসমাজের বিরক্তি, বিরূপতা এবং হয়তো বা ভীতির উদ্রেক করেছে। এই সমাজের সুস্থবুদ্ধি এবং রুচিবোধের যতখানি আজও অবশিষ্ট আছে, তা এই উগ্র, হুমকি-বহুল, দাম্ভিক রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে থাকতে পারে। এই রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফলের অনেকটাই বোধ করি বিজেপির আত্মঘাতী গোল।
তার পাশাপাশি আরও এক বার প্রমাণিত হল রাজ্যের শাসক দল ও তার সর্বময়ী নেত্রীর ‘খেলা’র প্রতিভা। এক দিকে অসংখ্য জনবাদী প্রকল্প ও কর্মসূচির মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষের কাছে কিছু না কিছু সরকারি অর্থ ও সুযোগসুবিধা পৌঁছে দেওয়া, অন্য দিকে বিজেপির রাজনৈতিক মোকাবিলাকে কেন্দ্র-রাজ্য দ্বৈরথে নিয়ে গিয়ে মোদী-বাহিনীর প্রচার-তরঙ্গকে স্বাভিমানী বঙ্গসমাজের বিরুদ্ধে ‘বহিরাগত’ ক্ষমতাবানদের আগ্রাসন হিসাবে প্রতিপন্ন করা— এই দুই অস্ত্রই প্রবল উদ্যমে ব্যবহার করেছেন তাঁরা এবং বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক পরিসরটি নিজেদের দখলে রাখতে পেরেছেন। রাজ্যের জনবিন্যাস নিশ্চয়ই এই প্রকল্পে সহায় হয়েছে, কিন্তু তাতে তাঁদের সাফল্য খাটো হয় না। সেখান থেকেই বৃহত্তর ও গভীরতর প্রশ্নটি উঠে আসে। রাজ্য রাজনীতিতে এমন একাধিপত্য কি গণতন্ত্রের পক্ষে উদ্বেগজনক নয়? বিশেষত, রাজ্যের শাসক দলের আচরণেও যখন ক্রমাগত মজ্জাগত আধিপত্যবাদ এবং সর্বব্যাপী দুর্নীতির উৎকট নজিরগুলি অতিমাত্রায় প্রকট? এই উদ্বেগের নিরসন হতে পারে যথার্থ গণতান্ত্রিক এবং উন্নয়নমুখী বিরোধী রাজনীতির জোরে, অন্য পথ নেই। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে সেই উত্তরণের সুলক্ষণ দেখা গেল। রাজ্য রাজনীতি এখনও তার প্রতীক্ষায়।