দিলীপ মহলানবিশ।
ওআরএস বা ‘ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন’-এর পথিকৃৎ দিলীপ মহলানবিশের প্রয়াণসংবাদে তাৎক্ষণিক জনপ্রতিক্রিয়ার যে রূপ দেখা গেল তার সারমর্ম, ‘আমরা জানতামই না এমন এক জন মানুষ আমাদের মধ্যে, এই শহরেই ছিলেন!’ দ্য ল্যানসেট-এর মতো জার্নাল যাঁর ‘সৃষ্টি’কে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘মেডিক্যাল ডিসকভারি’ আখ্যা দিয়েছে, ডায়রিয়া কলেরার মতো রোগে যাঁর ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরি ‘ওষুধ’ অনুমোদন, সমর্থন এবং আবিশ্ব প্রচার ও প্রয়োগ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী ক্যাম্পে কলেরা-আক্রান্ত অজস্র প্রাণ রক্ষা পেয়েছিল যাঁর কল্যাণে, সেই চিকিৎসক-গবেষক পাকাপাকি ভাবে থাকতেন ইউরোপ-আমেরিকায় নয়, এই দেশে, এই শহরেই, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন এ মাসেরই শুরু থেকে— সাধারণ্যে বা প্রচারমাধ্যমে সে খবর ছিল না। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দুনিয়ায় যাকে মনে করা হয় পিডিয়াট্রিক্স তথা শিশুরোগবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারের সমতুল্য, দুই দশক আগে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সেই ‘পলিন প্রাইজ়’ জয়ী মানুষটির কাজের গুরুত্ব এখন খানিক বোঝা যাচ্ছে— প্রয়াণোত্তর বিহ্বলতার আবহে।
পুরস্কার ও সম্মাননা সব সময় সব ক্ষেত্রে একটি মানুষের জীবনকৃতির পরিচায়ক নয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও বরিষ্ঠ বিজ্ঞানী লেখক শিল্পী খেলোয়াড়দের অনেকেই তথাকথিত সেরা সম্মানগুলি পাননি। পুরস্কার এক জন কর্মী ও গুণীর পরিচিতিকে ব্যাপ্ত বিস্তৃত করে দেয়, বিশ্ব তাঁর কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত ও সচেতন হয়, সম্মাননার গুরুত্ব এখানেই, এইটুকুতেই। দিলীপ মহলানবিশ বিশ্বের বহু সম্মাননা পেয়েছিলেন, অথচ স্থানীয় স্তরে স্বীকৃতি মেলেনি তত, জানা যাচ্ছে। এ কি এক জন বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানীর কাজের গুরুত্ব স্বীকারে বঙ্গবাসীর চূড়ান্ত ব্যর্থতা নয়? ডায়রিয়া বা জলশূন্যতার চিকিৎসা হিসেবে ওআরএস এবং তারও সরলীকৃত ‘নুন-চিনির জল’-এর কথা ঘরে ঘরে সবাই জানেন, কিন্তু নামমাত্র খরচের সেই মহৌষধটি বঙ্গে ও বিশ্বে ছড়িয়ে দিলেন যিনি, তাঁকে না চেনা, মনে না রাখা এক প্রকার নৈতিক অপরাধের নামান্তর, জাতি হিসেবে বাঙালি সে অপরাধে অপরাধী। মৃত্যুর পরে গুণগান ও মহত্ত্ব-কীর্তন করাই যায়, বঙ্গবাসী করছেনও, কিন্তু এই মহাজীবনের স্মরণ ও শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ জরুরি ছিল অনেক আগেই।
ভারতও কি ভুলে ছিল না এই চিকিৎসক-গবেষককে? বিজ্ঞান-গবেষণা এক সময়সাপেক্ষ সাধনা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানীদের কাজের কোনও তাৎক্ষণিক চটক বা আকর্ষণ নেই, তাঁদের প্রভাব বোঝা যায় প্রায়োগিক জীবনে, বহু ক্ষেত্রেই দীর্ঘ কাল পরে— সে কারণেই বিজ্ঞানীরা ঢাকা পড়েন বিস্মৃতির আড়ালে। অথচ বিজ্ঞানকৃতির হাত ধরেই উন্নত হয় দেশের অর্থনীতি, কৃষি, পরিবহণ, স্বাস্থ্য। বিজ্ঞানীদের সম্মান ও স্বীকৃতির দায়িত্ব তাই রাষ্ট্রের প্রশাসকদের; শিল্পী গায়ক চিত্রতারকা লেখকের মতোই তাঁদের অবদানকেও গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরলে জনসমাজ তাঁদের বিস্মৃত হবে না। বিজ্ঞানীরা নিজেদের জন্য কাজ করেন না, করেন বিজ্ঞানের জন্য, মানুষের জন্য, এই সারসত্য বোঝা দরকার, দরকার বিজ্ঞান-গবেষণা পরিকাঠামোয় অর্থ বরাদ্দ ও স্বীকৃতি বৃদ্ধিরও। তাতে দেশ উন্নত হবে, আর বিজ্ঞানীর মৃত্যুর পরে তাঁকে ‘প্রথম চেনা’র আক্ষেপ ও অপরাধবোধেও ভুগতে হবে না।