পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে নিয়োগ সংক্রান্ত অনাচারের চলৎ-চিত্রের গতি ও প্রকৃতি অবলোকন করে দুর্নীতি নিজেও হয়তো স্তম্ভিত। ‘আপাদমস্তক দুর্নীতি’ কথাটা এমন আক্ষরিক অর্থে সত্য হয়ে উঠতে পারে, বহু নাগরিকের কাছেই তা— আক্ষরিক অর্থেই— অকল্পনীয় ছিল। প্রাথমিক থেকে শুরু করে কার্যত প্রত্যেকটি শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগে যে বিপুল দুর্নীতির উৎকট উপসর্গগুলি প্রতিনিয়ত প্রকট হয়ে চলেছে, তার সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে বিপুলসংখ্যক শিক্ষাকর্মী নিয়োগে অনিয়মের কাহিনি। উচ্চ আদালতের বিচারপতি বেআইনি ভাবে নিযুক্ত চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের স্কুলে ঢুকতে না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং রাজ্য সরকার আদালতকে জানিয়েছে, এখনই কর্মীদের চাকরি বাতিল হলে স্কুলে দরজা-জানলা খোলার লোক থাকবে না। কেবল এই একটি ‘আবেদন’ই স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয়, পরিস্থিতি কোন অতলে পৌঁছেছে। এক দিকে অন্তহীন দুর্নীতির নিত্যনতুন সাক্ষ্যপ্রমাণ, অন্য দিকে লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর অনন্ত বিপন্নতা— বিচারপতিদের ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার গভীরে নিহিত আছে এক বিপদবার্তা। আদালতের অসামান্য তৎপরতা কেবল পরিব্যাপ্ত দুর্নীতির চিত্রটি উন্মোচিত করেনি, উন্মোচন করেছে এই ভয়াবহ সত্যটিকেও যে— পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলশিক্ষার গোটা ব্যবস্থাটাই পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতির ভারে ভেঙে পড়ছে।
অথচ, এই বিপর্যয়ের দায়দায়িত্ব যাদের, সেই সরকার এবং শাসক দলের মন্ত্রী-সান্ত্রি তথা নেতা ও মুখপাত্ররা ‘তদন্ত চলছে’ অথবা ‘আদালতের পর্যবেক্ষণ নিয়ে কিছু বলার নেই’ গোছের বহুব্যবহৃত ডুমুরপাতা দিয়ে সর্বাঙ্গের দগদগে কলঙ্ক ঢাকার চেষ্টা চালাচ্ছেন, যা দেখলে যে কোনও সচেতন এবং সুচেতন নাগরিকের বিবমিষার উদ্রেক হওয়াই স্বাভাবিক। দুর্নীতির কাহিনি আর বাছাই-তালিকার নীচের দিকে থাকা প্রার্থীর নাম উপরে তুলে আনায় সীমিত নেই, নিয়োগ-পরীক্ষায় শূন্য খাতা জমা দিয়ে প্রায় ‘ফুল মার্কস’ প্রাপ্তির ইন্দ্রজাল থেকে শুরু করে আদালতে এমন বহু প্রাথমিক শিক্ষককে পাওয়া গিয়েছে যাঁরা নিয়োগ-পরীক্ষার জন্য আবেদনপত্রের প্রতিলিপি অবধি জমা দিতে পারেননি, অর্থাৎ তাঁরা আদৌ পরীক্ষায় বসেছিলেন কি না তা নিয়েই গভীরতম সংশয়! গত এক দশকে শিক্ষার পরিসরে যত নিয়োগ হয়েছে তার অধিকাংশই বেআইনি, দুর্নীতিগ্রস্ত— বিরোধী রাজনীতিকদের এই অভিযোগ যেন উত্তরোত্তর সত্যের আরও কাছে পৌঁছচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের বুকে কান পাতলে এখন বোধ করি শোনা যাবে একটি আর্ত প্রশ্ন: ক্ষমতা, ক্ষমতা, তোমার লজ্জা নাই শাসক?
সদুত্তর দেওয়া দূরের কথা, এ-প্রশ্ন কানে তোলবার বিন্দুমাত্র সদিচ্ছাও কি শাসকদের আছে? থাকলে, প্রতিবাদী নিয়োগ-প্রার্থীদের আন্দোলনকে ছলে বলে কৌশলে দমনের চেষ্টা না করে তাঁরা সেই আন্দোলনের প্রথম পর্বেই আস্তাবলের আবর্জনা সাফ করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কিন্তু তেমন কোনও উদ্যোগের চিহ্নমাত্র নেই। সাফাইয়ের কাজ যতটা এগিয়েছে, সেটা আদালতের তাড়নায় এবং কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার আংশিক তৎপরতায়, যদিও সেই তৎপরতার মাত্রা ও স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় আছে, বিশেষত যে-হেতু কেন্দ্রীয় তদন্তের গতিপ্রকৃতির উপর কেন্দ্র-রাজ্য রাজনীতির গূঢ় প্রভাবের কথা ও কাহিনি সর্বজনবিদিত। সেই কারণেই, শেষ বিচারে, আদালতই একমাত্র ভরসা। রাজ্যের শাসকদের আচরণ দেখলে এমন কথা মনে হওয়াই অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, দুর্নীতি তাঁদের অচলায়তনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তৃণমূল অবধি পরিব্যাপ্ত, তাই আবর্জনা সাফ করতে তাঁদের উদ্যোগী হওয়ার কোনও আশা নেই, এমনকি কোনও প্রশ্নও নেই। এই অনুমান যদি ভুল হয়, তবে তাকে ভুল প্রমাণ করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তাঁদেরই।