পানীয় জলই যখন পানের অযোগ্য হয়ে পড়ে, তখন পরিস্থিতি কতখানি জটিল হতে পারে, শিলিগুড়ি সম্প্রতি তা দেখিয়ে দিল। গত অক্টোবরের হড়পা বানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তিস্তার উপরে গজলডোবা বাঁধটি। বর্ষার পূর্বেই প্রয়োজন ছিল মেরামতের। ফলত তিস্তা থেকে জল উত্তোলন বন্ধ রাখা হয়েছিল। তিস্তা-মহানন্দা লিঙ্ক ক্যানালের জল তুলেই শিলিগুড়ি শহরে তা বণ্টন করা হয়। কিন্তু সেই সরবরাহ বন্ধ থাকায় বিকল্প হিসাবে মহানন্দার জল পরিস্রুত করে শহরে বণ্টনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শিলিগুড়ি পুরসভা। সেই ভাবনা কাজে আসেনি। মহানন্দার জলের মান যে বিপজ্জনক, তা স্বীকার করে এক সময় শিলিগুড়ি পুরনিগমের তরফে সরবরাহ করা জলও পান করতে নিষেধ করেছিলেন খোদ মেয়র গৌতম দেব। ফলে, শিলিগুড়িতে জলসঙ্কট তুঙ্গে ওঠে। শহর জুড়ে পানীয় জলের হাহাকার, জল নিয়ে কুৎসিত রাজনীতি, যথেচ্ছ কালোবাজারির সাক্ষী থাকল উত্তরবঙ্গের এই গুরুত্বপূর্ণ শহর। আপাতত সেই সঙ্কট মিটেছে। বাঁধ মেরামতি-অন্তে তিস্তা থেকে জল ছাড়া হয়েছে। সেই জল পরিস্রুত করে মেয়রের ঘোষণামতোই ২ জুন থেকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার কাজও শুরু হয়েছে।
কিন্তু এই সমগ্র সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে ওঠা প্রশ্নগুলি থেকেই যাচ্ছে। মহানন্দার জল যে তিস্তার জলের বিকল্প হতে পারে না, সেই তথ্য পুরসভার কাছে থাকা সত্ত্বেও কেন সেই জল বণ্টনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল? মহানন্দার জল দূষণ নতুন কথা নয়। অতীতে বাম আমলেও তিস্তার বিকল্প হিসাবে মহানন্দার জলকে তুলে ধরার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। দ্রুত এবং পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ এবং বিপুল পরিমাণ আবর্জনা জমার কারণে এই নদীর দূষণ দীর্ঘ দিনই লাগামছাড়া। সেই নদীকে পুনরুজ্জীবিত করার যথেষ্ট প্রয়াস নেওয়া হয়নি কোনও সরকারের আমলেই। আশ্চর্য যে, এ ক্ষেত্রেও মেয়র গৌতম দেব স্বীকার করে নিয়েছিলেন, মহানন্দার গভীরতা কম হওয়ায় তা তিস্তার জলের মতো শুদ্ধ নয়। তা সত্ত্বেও প্রাথমিক ভাবে সেই জলকে ‘নিরাপদ’ হিসাবে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল। পুরসভাই যদি নাগরিককে দূষিত জল ব্যবহারে বাধ্য করে, তবে তা ক্ষমার অযোগ্য। মহানন্দা ছাড়াও শহরের মধ্য দিয়ে জোড়াপানি, ফুলেশ্বরী, সাহু নদীকে দূষণমুক্ত করার কথা সম্প্রতি জানিয়েছেন মেয়র। প্রশ্ন, দূষণমুক্তির গুরুত্ব বুঝতে জলসঙ্কটের মতো পরিস্থিতির প্রয়োজন হল কেন?
এই জলসঙ্কটের অন্য দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। জল নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা না থাকলে কী হতে পারে, শিলিগুড়ি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল। সম্প্রতি প্রবল তাপপ্রবাহের কালে কলকাতা পুরসভা জল অপচয় বন্ধ করার আবেদন জানিয়েছিল। কারণ, তীব্র গ্রীষ্মে গঙ্গার জলস্তর এতটাই নেমে গিয়েছিল যে, পরিস্রুত জল উৎপাদন করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। সেই আবেদন কি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে নাগরিকদের কাছে? নিঃসন্দেহে শিলিগুড়ি এবং কলকাতার পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন। ভিন্ন বলেই তা সবিশেষ চিন্তার। তিস্তার বাঁধ মেরামতির কাজটি ছিল সাময়িক। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে গঙ্গার জলস্তর যদি ক্রমশ নামতে থাকে এবং সেই বিষয়ে সরকার ও নাগরিক উভয়েই সমান সচেতন না হয়, তবে আগামী দিনে দৈনন্দিন প্রয়োজনের জলটুকুও অমিল হবে। এই দুর্দিন ঠেকানোর ভাবনা সরকার ও নাগরিকের আছে কি?