আদালতের উপর, বিশেষত সর্বোচ্চ আদালতের উপর নাগরিকদের ভরসা থাকা গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের এক আবশ্যিক শর্ত। সমস্যা দেখা দেয় তখনই, যখন সেই ভরসা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে ওঠে। তিনমহলা সংসদীয় শাসনতন্ত্রের অন্য দুই অঙ্গ, আইনসভা ও প্রশাসন, নিজেদের কাজ ঠিক মতো না করলে, বিশেষ করে শাসকরা অপদার্থতা এবং অনাচারের পথ ধরলে এই সমস্যা গভীরতর হয়, সমাজ আদালতকে এক অমিতশক্তিধর মুশকিল আসান হিসাবে দেখতে শুরু করে। এবং সেই প্রত্যাশা পূর্ণ না হলে অনেকেই, যেন এক প্রতিবর্ত প্রক্রিয়ায়, হতাশ হয়ে আদালতের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন, সেই ক্ষোভের বিষয়বস্তু এবং ভাষা-ভঙ্গি অনেক সময়েই সংযম হারায়। আর জি কর হাসপাতালের ঘটনা সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের শুনানি সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজের একাংশের প্রতিক্রিয়ায় এই লক্ষণগুলি প্রকট। আদালতের প্রক্রিয়া নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন থাকতে পারে, তার গতি দ্রুততর করে তোলার প্রত্যাশা বা দাবি সব সময়েই সঙ্গত, কিন্তু সেই প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব নীতি ও অনুশাসন মেনে চলতে হয়— এই প্রাথমিক সত্যটি মনে রাখা জরুরি। শাসক শিবির থেকে যখন ধর্ষককে সাত দিনে ফাঁসি দেওয়া কিংবা এনকাউন্টারে সাফ করার উৎকট সওয়াল শোনা যায়, তখন আরও বেশি জরুরি।
সোমবারের শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতির প্রশ্নমালায়, মন্তব্যে এবং নির্দেশে বারংবার যে বিষয়টিতে জোর দেওয়া হয়েছে তার নামও প্রক্রিয়া— ৯ অগস্ট নির্যাতিতা চিকিৎসক-শিক্ষার্থীর মৃতদেহের সন্ধান পাওয়ার পর থেকে পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়া। শুরু থেকেই গভীর সংশয় ছিল যে, এই প্রক্রিয়া যথাযথ ভাবে চলেনি, বরং তাতে নানা ভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে এবং তার ফলে তথ্যপ্রমাণ লোপ করার সম্ভাবনাও প্রবল। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিশেষ গুরুতর হয়ে ওঠে বিচারপতিদের সোমবারের বিভিন্ন মন্তব্য। ময়না তদন্তের জন্য অত্যাবশ্যক আর্জিপত্র বা ‘চালান’ উধাও হয়ে গিয়ে থাকলে (বা চালান ছাড়াই ময়না তদন্ত হলে) তা বড় রকমের গোলযোগের সঙ্কেত দেয় কি না, মৃতদেহ উদ্ধারের পরে এফআইআর দায়ের করতে ১৪ ঘণ্টা সময় লাগবে কেন, সিসিটিভির দৃশ্য-নথিতে অসম্পূর্ণতা বা অন্যবিধ ত্রুটি আছে কি না, বিশেষত ঘটনাস্থলে তল্লাশির যথাযথ ফুটেজ আছে কি না— প্রত্যেকটি প্রশ্নই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এবং প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই, বিশেষত চালান সংক্রান্ত প্রশ্নে, রাজ্য সরকারের আইনজীবীদের সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থা টেলিভিশনের পর্দায় দেখার পরে অগণন দর্শক নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে প্রশাসনকে অতঃপর বিস্তর কৈফিয়ত দিতে হবে। কী ভাবে সেই কৈফিয়ত নির্মিত বা সজ্জিত হবে, সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য। কিন্তু একটি সত্য সুস্পষ্ট: গোটা ঘটনায় প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের ক্ষমতাবানদের ভূমিকা নিয়ে শুরু থেকেই যে সন্দেহ ছিল, সোমবারের শুনানির মধ্য দিয়েই তা আরও অনেক বেশি ঘনীভূত ও সুনির্দিষ্ট হয়েছে।
এই প্রক্রিয়া কি শেষ অবধি সমস্ত সংশয় নিরসন করতে পারবে? ভয়াবহ ঘটনাটিতে জড়িত বা সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের চিহ্নিত করা এবং শাস্তি দেওয়ার প্রত্যাশা কি পূর্ণ হবে? রাজ্যের সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল তথা স্বাস্থ্য দফতরের গোটা সাম্রাজ্যটির স্তরে স্তরে বিপুল দুর্নীতি ও দুরাচারের যে অজস্র অভিযোগ প্রতি দিন অজস্রতর হয়ে চলেছে, তার সঙ্গে এই ধর্ষণ-হত্যাকাণ্ডের সংযোগ থাকলে তার সূত্রগুলি উদ্ধার করা হবে কি? নবজাগ্রত নাগরিক সমাজ নিশ্চয়ই এই সমস্ত প্রশ্ন নিয়ে তদন্ত এবং বিচারপ্রক্রিয়ার দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টি রাখবেন, যে কোনও ধরনের বিচ্যুতি বা দীর্ঘসূত্রতা দেখলে প্রশ্ন তুলবেন। এরই নাম ‘ইটার্নাল ভিজিল্যান্স’— নিরন্তর নজরদারি। অস্থিরতা নয়, অবিমৃশ্যকারিতা নয়, একাগ্র সতর্কতায় সুস্থিত থাকাই এখন সমাজের সমস্ত সুচেতন নাগরিকের কর্তব্য।