আশা ছিল, এই বার অন্তত নিয়ম মানবে মানুষ। নিয়মভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে তৎপর হবে পুরসভাও। সে আশা যে একেবারে পূর্ণ হয়নি, তেমনটা বলা যায় না। ১ জুলাই থেকে ভারতে এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের উৎপাদন, আমদানি, মজুত, সরবরাহ, বিক্রি এবং ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ার পর অন্তত গোড়ার দিকে কিছু দিন প্রশাসনিক তৎপরতা, জরিমানা এবং নাগরিক সচেতনতা— সবেরই এক দুর্লভ সমাহার দেখা গিয়েছিল। পূর্বের তুলনায় নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ব্যবহার যে অনেকটাই কমেছে, তাও অনস্বীকার্য। কিন্তু একেবারে বন্ধ হয়নি। বরং, কলকাতাতেও বিভিন্ন জায়গায় ফের দেখা মিলেছে নিষিদ্ধ প্লাস্টিক সামগ্রীর। এবং পাল্লা দিয়ে কমেছে বাজার-দোকানে চটের থলে বা কাপড়ের ব্যাগ হাতে প্রবেশের নাগরিক প্রবণতা। গত ১৫ অগস্ট শহরে দেদার বিক্রি হয়েছে ৭৫ মাইক্রনের কম ঘনত্বের প্লাস্টিকের পতাকা। জেলাগুলির অবস্থাও তথৈবচ। উৎসবের মরসুম চলছে। সাধারণ সময়েই যদি নজরদারির এমন অবস্থা হয়, তবে উৎসবের মরসুমে যে নিয়ম ভাঙার প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পাবে, তা সহজে অনুমেয়।
বস্তুত, এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের কুফল সম্পর্কে সর্বস্তরে প্রচারের কাজটি আরও জোরদার না হলে শুধু আইন আর জরিমানার ভয় দেখিয়ে এই কুঅভ্যাস থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। শহরাঞ্চলে নিকাশিব্যবস্থার ক্ষেত্রে কুফলটি দৃশ্যমান। যত্রতত্র প্লাস্টিক ফেলার প্রবণতা নিকাশি নালার মুখগুলিকে আটকে দেওয়ায় প্রতি বর্ষায় নিয়ম করে শহরের বিভিন্ন অঞ্চল জলমগ্ন হয়। পাম্প চালিয়েও দ্রুত সেই জল নামানো সম্ভব হয় না। জল জমে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। কিন্তু আরও বৃহত্তর যে ক্ষতিটি প্রত্যক্ষ করা যায় না, অথচ সকলের চোখের আড়ালে নীরবে ধ্বংসের কাজটি করে চলে, নাগরিককে সজাগ করতে হবে সেটা নিয়েও। এক বার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক কখনও সম্পূর্ণ ভাবে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতে পারে না। বরং, বছরের পর বছর ফাঁকা জমি, সমুদ্রের পারে সঞ্চিত হয়ে এক সময় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণায় ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়। প্রতি বছর খাবারের সঙ্গে শরীরে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করায় প্রচুর সামুদ্রিক পাখি, কচ্ছপ, মাছ, এবং তিমির মতো প্রাণীর মৃত্যু ঘটে। এবং খাদ্যের সঙ্গে মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করে মানবশরীরেও। প্লাস্টিকের বোতল, ব্যাগ, খাবারের পাত্রের মধ্যে থাকা রাসায়নিক ক্যানসার, জিনঘটিত নানা ব্যাধির জন্ম দেয়, এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে।
তাই প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করতেই হবে। প্রচার, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, এবং অমান্যকারীকে কড়া শাস্তি প্রদান— এ ছাড়া এই বিষচক্র থেকে রেহাই নেই। পুজো শুরুর পূর্বেই এই বছর নিয়ম মেনে মণ্ডপ নির্মাণ, পুজো প্রাঙ্গণে ১০০ মাইক্রনের কম ঘনত্বযুক্ত প্লাস্টিকের ব্যানার না রাখার ব্যাপারে পুজোকর্তাদের মুচলেকা দেওয়ার কথা জানিয়েছিল রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। মণ্ডপ তৈরির উপকরণ থেকে থার্মোকল, প্লাস্টিকের মতো বস্তুকে বাদ দেওয়ার কথাও বলা হয়। একই সঙ্গে প্লাস্টিক নিয়ে দর্শনার্থীদের সতর্ক করার বিষয়টিও উঠে এসেছিল আলোচনায়। এ ধরনের উদ্যোগ স্বাগত। একই সঙ্গে স্বল্প মূল্যে প্লাস্টিকের বিকল্প দ্রব্যগুলির জোগান যাতে বাজারে পর্যাপ্ত থাকে, নজর দিতে হবে সে ক্ষেত্রেও। এবং সতর্ক হতে হবে নাগরিককে। বারংবার সাবধানবাণী সত্ত্বেও তাঁরা যে অত্যন্ত ক্ষতিকর এক পদার্থকে জীবন যাপনের অঙ্গ করে নিয়েছেন, এবং বহু অনুরোধ-শাস্তির প্রদানের ভয়েও যে সেই কুঅভ্যাস থেকে মুক্ত হতে পারছেন না, সেটা দুশ্চিন্তার বইকি। নাগরিক যদি সচেতন হন, প্রশাসনও তৎপর হতে বাধ্য হবে। এই সহজ কথাটি দ্রুত উপলব্ধি করা প্রয়োজন।