Disasters

ভয়াবহ এবং স্বাভাবিক

এই বিপর্যয়ে প্রকৃতির ভূমিকা যতখানি, মানুষের চূড়ান্ত অবিবেচনা এবং যথেচ্ছাচারের ভূমিকা তার থেকে অনেক বেশি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০২৪ ০৭:৪৭
Share:

অঘটন বা দুর্ঘটনার মতো শব্দগুলি ক্রমশই অর্থহীন হয়ে পড়ছে। এমনকি যে ধরনের বিপর্যয়কে কিছুকাল আগেও প্রাকৃতিক দুর্দৈব ছাড়া অন্য কিছু বলে ভাবাই যেত না, এখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার পিছনে মানুষ নামক প্রজাতিটির ভূমিকা স্পষ্টতই প্রবল। কেরলের ওয়েনাড়ে গত মঙ্গলবার মধ্যরাত্রে যে ধ্বংসকাণ্ড কয়েকশো প্রাণ হরণ করেছে, অগণন নাগরিকের জীবনে সর্বনাশ ডেকে এনেছে এবং অন্তত চারটি গ্রামের কার্যত বিলুপ্তি-সহ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জনজীবন, প্রকৃতি ও পরিবেশের অকল্পনীয় ক্ষতি সাধন করেছে, তার প্রত্যক্ষ কারণ নিশ্চয়ই অতিবর্ষণ, ওই অঞ্চলের ভঙ্গুর ও অস্থির ভূপ্রকৃতির সঙ্গে মিলে যা এমন বিধ্বংসী পরিণাম ডেকে আনতে পারে। কিন্তু সেই পরিণামকে বহুগুণ ভয়াবহ করে তুলেছে ওই অঞ্চলে এক দিকে পর্যটন এবং অন্য দিকে পাথর, বালি ও অন্যান্য ‘সম্পদ’ খনন, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও তার সংশ্লিষ্ট যাবতীয় আয়োজনের লাগামছাড়া প্রসার। এই বিপর্যয়ে প্রকৃতির ভূমিকা যতখানি, মানুষের চূড়ান্ত অবিবেচনা এবং যথেচ্ছাচারের ভূমিকা তার থেকে অনেক বেশি।

Advertisement

অথচ সতর্কবাণীর কোনও অভাব ছিল না, অভাব ছিল না নির্দিষ্ট পথনির্দেশেরও। দীর্ঘদিন ধরেই বিশেষজ্ঞরা বিশদ সমীক্ষা ও গবেষণার ভিত্তিতে জোর দিয়ে বলে এসেছেন, ওই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি এমন বিপদসম্ভব বলেই তাকে সর্বতোভাবে সুরক্ষিত রাখা অত্যন্ত জরুরি, তার স্পর্শকাতর ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এমন সমস্ত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা জরুরি। পশ্চিমঘাট পর্বতের সংশ্লিষ্ট এলাকার বাস্তুতন্ত্র তথা প্রকৃতি-পরিবেশের সুরক্ষার উদ্দেশ্যে মাধব গ্যাডগিলের মতো বিশ্ববিশ্রুত পরিবেশ-বিজ্ঞানীদের নেতৃত্বে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রায় এক যুগ আগে এই বিষয়ে অত্যন্ত মূল্যবান সুপারিশ করেছিলেন। কোথায় কী ভাবে পরিবেশের স্বার্থ রক্ষা করে উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন তাঁরা। কেরল-সহ ছ’টি রাজ্যকে নিয়ে সুস্থ এবং সুষ্ঠু সমন্বয়ের ভিত্তিতে সেই পরিকল্পনা রূপায়ণের প্রয়োজন ছিল।

সেই প্রয়োজনের কত শতাংশ পূরণ করা হয়েছে, তা জানতে গেলে শক্তিশালী আতশকাচের দরকার হবে। বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশ কার্যকর করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার মাঝে মাঝে নির্দেশিকা জারি করেছে, এইমাত্র। লক্ষণীয়, সাম্প্রতিকতম নির্দেশিকাটি এসেছে গত সপ্তাহে, এ-বারের বিপর্যয়ের পরে! ইতিমধ্যে ‘ঈশ্বরের আপন দেশ’-এ দেশদেশান্তর থেকে পর্যটকদের ডেকে আনার বিপুল বাণিজ্য চলেছে অপ্রতিহত গতিতে, আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে পর্বত ও অরণ্যের সুস্থিতি বিনাশ করে ‘উন্নয়ন’-এর ধুন্ধুমার কর্মকাণ্ড। প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যই প্রকৃতির ভয়ানক বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, নিরন্তর নির্মাণই ডেকে এনেছে মারাত্মক ও মর্মান্তিক ধ্বংসকে। ওয়েনাড় কোনও ব্যতিক্রম নয়, পশ্চিমঘাট পর্বতের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অঞ্চলেই রচিত হয়ে চলেছে এই একই বিধ্বংসী কাহিনি। এবং, শুধু সেখানে নয়, গোটা দেশেই উত্তরোত্তর প্রকট হয়ে চলেছে পরিবেশের প্রতি এই ভয়াবহ ঔদাসীন্যের সর্বনাশা পরিণাম। ২০১৩ সালের জুন মাসে উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথে অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের সময়েও এই একই কথাগুলি বলা হয়েছিল, অস্থির ও স্পর্শকাতর পাহাড়ে নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ওই অঞ্চলে পর্যটন— প্রধানত ধর্মাশ্রিত পর্যটন— কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কতটুকু ফল হয়েছে, তা সর্বজনবিদিত। ওয়েনাড়ের ঘটনা নতুন করে দেখিয়ে দিল যে বসতি, পর্যটন এবং তথাকথিত উন্নয়নের বিস্তারকে প্রকৃতি-পরিবেশের বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিয়ন্ত্রণ না করলে একেবারে আক্ষরিক অর্থেই পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবে। তাকে দুর্ঘটনা বলে ভাবের ঘরে চুরি করে চললে এমন বিপর্যয়ই স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement