গৌতম আদানি। ফাইল ছবি।
দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে ঢেকে ফেলা যায় অনেক কিছুই। শিল্পপতি গৌতম আদানির সত্যিই কিছু গোপন করার আছে কি না, সময়ই সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে। কিন্তু, তাঁর সংস্থার অবৈধ আর্থিক কর্মকাণ্ড বিষয়ে আমেরিকান সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ-এর তোলা অভিযোগগুলিকে আদানি যে ভঙ্গিতে ‘ভারতের বিরুদ্ধে হিসাবি আক্রমণ’, ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের ‘স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও গুণমান’-এর বিরুদ্ধে আঘাত বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন, তাতে বলতে হয়, ‘কিউরিয়সার অ্যান্ড কিউরিয়সার’। আদানি মামলা করার হুমকি দিয়েছেন, ‘সব ঠিক আছে’ মর্মে ভিডিয়ো প্রকাশ করেছেন, আবার ‘নৈতিকতা’র কথা বলে বাজার থেকে তুলে নিয়েছেন সংস্থার ‘ফলো আপ পাবলিক অফার’ বা এফপিও। কিন্তু, কোনও অভিযোগের যথার্থ উত্তর দেননি। উত্তর দেওয়ার সময় দশ দিনেই ফুরোয় না বটে, কিন্তু এই সময়কালে শেয়ার বাজারে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের মোট মূল্য হ্রাস পেয়েছে ৫৪ শতাংশ। দেশের দুই প্রধান শেয়ার বাজার এনএসই এবং বিএসই-তে মোট মূল্যের ৬ শতাংশ আদানি গোষ্ঠীর দখলে ছিল, হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশের পর তা দাঁড়িয়েছে ৩ শতাংশ। আদানি গোষ্ঠীর সংস্থায় লগ্নি রয়েছে, অথবা সেই সংস্থাকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়েছে, এই কারণে বাজারে ধাক্কা খেয়েছে এলআইসি এবং স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার শেয়ারও। অনুমান করা চলে, আদানি গোষ্ঠীর কাছে যদি হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ-এর তোলা অভিযোগগুলির যথাযথ উত্তর থাকত, তা হলে এই ধস ঠেকাতে সংস্থাটি আরও সচেষ্ট হত।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে ভারতের আর্থিক ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে। আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলি প্রমাণ বা অপ্রমাণ হওয়া অবধি সে বিষয়ে মন্তব্য করা সমীচীন নয়। কিন্তু, পারিপার্শ্বিক প্রমাণ থেকে কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। বাজারে যত মিউচুয়াল ফান্ড আছে, তার মধ্যে ৪৭টি ফান্ড প্রত্যক্ষ ভাবে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে লগ্নি করেছিল। তার মধ্যে আদানি এন্টারপ্রাইজ় এবং আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকনমিক জ়োন ব্যতীত বাকি সব শেয়ারেই মিউচুয়াল ফান্ডের লগ্নি অকিঞ্চিৎকর। এই দুই সংস্থাতেও মিউচুয়াল ফান্ডের লগ্নি যৎসামান্য। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, যে গোষ্ঠীর শেয়ারের দাম মাত্র দু’বছরে ত্রিশ গুণেরও বেশি বাড়ে, ফান্ড ম্যানেজাররা সেই সংস্থাকে এড়িয়ে চললেন কেন? তবে কি ঘটনা এই যে, ভারতের আর্থিক নিয়ন্ত্রকরা যে গোলমালকে দেখেও না-দেখার ভান করে ছিলেন, অভিজ্ঞ ফান্ড ম্যানেজাররা সেই ঝুঁকিগুলিই এড়িয়ে চলতে চেয়েছিলেন? লক্ষণীয় যে, আদানি এন্টারপ্রাইজ়ের ৪.২৩ শতাংশ শেয়ার এলআইসি-র হাতে; আদানি পোর্টের ৯.১৪ শতাংশ, আদানি টোটাল গ্যাস-এর প্রায় ছয় শতাংশ। বেসরকারি ফান্ড ম্যানেজাররা যেখানে পা ফেলেন না, এলআইসি কেন, কোন তাড়নায় সেখানে প্রবেশ করে?
আদানি গোষ্ঠীর চলনে যে নানা বিপদসঙ্কেত রয়েছে, সে কথা বহুআলোচিত। সেই ‘রেড ফ্ল্যাগ’গুলি সামান্য নয়। যেমন, ২০১৮ সালে যখন গোষ্ঠীর মোট লাভ ছিল ৩৫০০ কোটি টাকারও কম, তখন সংস্থাটি ১,৬৭,০০০ কোটি টাকার সম্প্রসারণ পরিকল্পনা ঘোষণা করে। যেমন, এই গোষ্ঠীতে লগ্নির একটা মোটা অংশ এসেছে এমন সংস্থা থেকে, যেগুলি ‘শেল কোম্পানি’ হওয়ার সম্ভাবনার কথা বহুচর্চিত। তার পরও আদানি গোষ্ঠীর উত্থান অব্যাহত থেকেছে। দৃশ্যতই এই সংস্থা সরকারের অতি পছন্দের— এতখানিই যে, এক বিদেশি সংবাদপত্র আদানিকে ‘মোদীর রকফেলার’ আখ্যা দেয়। অতিমারির মোকাবিলায় অর্থমন্ত্রী যে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন, বিশ্লেষণ বলেছিল যে, তাতে সর্বাধিক লাভের সম্ভাবনা আদানি গোষ্ঠীরই। সেই গোষ্ঠীর কারণে যখন ভারতের সমগ্র আর্থিক ক্ষেত্র প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে, তখন জবাব দেওয়ার দায় সরকারের উপরেও বর্তায় না কি?