—ফাইল চিত্র।
অন্য সব বিজেপি-শাসিত রাজ্যের আগে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়ন করে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামী বোধ করি তাঁর দল তথা সঙ্ঘ পরিবারের নায়কদের কাছে নিজের দর অনেকখানি বাড়িয়ে নিতে পেরেছেন। তবে তাঁর এই পদক্ষেপটি শুরুতেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথম প্রশ্ন, অনাবশ্যক অতিসক্রিয়তা নিয়ে। বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার বা দত্তক সংক্রান্ত বিষয়ক আইনে ‘লিভ ইন’ বা একত্রবাসের উপর নজরদারি কোন যুক্তিতে? বিবাহ ইত্যাদি বিষয়গুলির মধ্যে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা থাকে, কিন্তু দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক এক সঙ্গে বসবাস করতে চাইলে রাষ্ট্র সেই ব্যক্তিগত পরিসরে তার নথিপত্র জেল-জরিমানা সিপাই-সান্ত্রি নিয়ে ঢুকে পড়বে কোন গণতান্ত্রিক যুক্তিতে? স্পষ্টতই, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রবর্তনের সুযোগে সঙ্ঘ-সেবকরা নাগরিকদের বনিয়াদি ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করতে তৎপর। তৎপরতা নানা উপলক্ষে নানা ভাবেই চলে আসছে, চলতে থাকবেও। কিন্তু একেবারে আইন জারি করে ফেলতে পারলে মনোবাঞ্ছা ষোলো আনা মেটানো যায়।
দ্বিতীয় প্রশ্ন: জনজাতি সমাজকে যদি এই আইনের আওতার বাইরে রাখা হয়, তা হলে আর দেওয়ানি বিধি ‘অভিন্ন’ হল কোন হিসাবে? স্পষ্টতই, জনজাতিভুক্ত গোষ্ঠীগুলিকে পারিবারিক সম্পর্ক বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিজস্ব আচার মেনে চলতে দেওয়ার পিছনে বহুত্বের প্রতি বিজেপি সরকার বা তার দীক্ষাগুরুদের কোনও গণতান্ত্রিক শ্রদ্ধা কাজ করেনি, কাজ করেছে নির্ভেজাল ভোটের অঙ্ক। জনজাতির সমর্থন নিজেদের ভান্ডারে নিয়ে আসা এখন সঙ্ঘনায়কদের অন্যতম প্রধান নির্বাচনী রণকৌশল। তাঁরা বিলক্ষণ জানেন যে, অভিন্ন বিধি চাপিয়ে দেওয়ার নাম করলেও জনজাতির মানুষ কুপিত হবেন। কেবল একটি রাজ্যে নয়, দেশ জুড়েই। সুতরাং তাঁদের সযত্নে এই তৎপরতার বাইরে রাখা হয়েছে। বস্তুত, যথার্থ অভিন্ন বিধি প্রবর্তন এই শাসকদের কাছে মুখ্য নয়, মুখ্য হল এই প্রশ্নটিকে সংখ্যালঘু-শাসনের প্রকরণ হিসাবে ব্যবহার করা এবং সেই শাসনের জোর দেখিয়ে হিন্দু ভোট সংহত করা। লোকসভা নির্বাচন হবে এই প্রকল্পের নবপর্যায়। উত্তরাখণ্ডে তার বোধন হল।
তৃতীয় এবং প্রধানতম প্রশ্ন: এমন একটি প্রাচীন ও জটিল বিষয়ে আইন বানানোর জন্য এই যুদ্ধকালীন তৎপরতা বিসদৃশ নয় কি? গণ পরিষদে সংবিধান রচনার পর্ব থেকে শুরু করে সদ্য-স্বাধীন দেশে হিন্দু কোড বিল সংক্রান্ত বিতর্ক আজ বহুলাংশেই ইতিহাসে পরিণত। আশির দশকে শাহবানু মামলার পরবর্তী দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়কে পিছনে ফেলে দেশের সমাজ ও রাজনীতি ইতিমধ্যে নীতি এবং আদর্শের দিক থেকে, বিশেষত নারীর অধিকার ও মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেওয়ার তাগিদে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির যাথার্থ্য মেনে নেওয়ার পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। উত্তরাখণ্ডের আইন-প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়াতেও সেই সত্যের পরিচয় মিলেছে— মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের মতো স্বার্থবদ্ধ শিবিরগুলি ছাড়া প্রায় কেউই অস্বীকার করেনি যে, দেওয়ানি বিধিতে সমতা আনার লক্ষ্যটি ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু কোন পথে লক্ষ্যে পৌঁছনোর চেষ্টা করা উচিত, গণতন্ত্রে তার গুরুত্বও কোনও অংশে কম নয়। এমন একটি বিষয়ে আইন প্রবর্তনের আগে কেবল বিধানসভায়, সংসদে এবং বৃহত্তর নাগরিক সমাজেও ব্যাপক আলোচনা অত্যাবশ্যক। বস্তুত, তেমন জন-বিতর্কের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত আইন গণতন্ত্রের বিচারে অনেক বেশি গ্রহণীয় হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কারবারিরা জন স্টুয়ার্ট মিল বা য়ুরগেন হাবারমাস কথিত আলোচনা-নির্ভর গণতন্ত্র নিয়ে ভাবিত নন, তাঁরা সংখ্যালঘুদের অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দাপট দেখিয়ে সংখ্যাগুরুদের পরিতৃপ্ত করতে তৎপর। তার ফলে যদি সামাজিক শান্তি ও সুস্থিতি ব্যাহত হয়, বিদ্বেষের বিষবাষ্প ফেনিয়ে ওঠে, মেরুকরণের খেলা দ্বিগুণ জমে উঠবে।