আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত মাসে গণতন্ত্র বিষয়ে তীব্র কিছু মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর চরিত্রবিশিষ্টতায় মন্তব্যগুলি তত সজোরে ধ্বনিত হয়নি বটে, তবে কথাগুলি অবধানপূর্বক শুনলে বুঝতে অসুবিধা হয় না, কতখানি জোর তার মধ্যে নিহিত। সাম্প্রতিক কালে যে কোনও জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষবিষ ঢেলে দেওয়ার এই যে চল দেখা যাচ্ছে আধুনিক গণতন্ত্রগুলিতে— যার মধ্যে আমেরিকা থেকে ভারত সব দেশই নাম লিখিয়েছে— তাতে গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট। বলেছেন, উনিশশো ত্রিশের দশকে জার্মানি যে ভয়ঙ্কর নাৎসি মানসিকতার জন্য মানবসভ্যতার কলঙ্ক হয়ে আছে, আবার তার উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে এ সব দেশে। ‘ঈশ্বর রক্ষা করুন’, এই যদি গণতান্ত্রিক আমেরিকা হয়, তা হলে মানবদুনিয়ার ভবিষ্যতের কী হাল হতে পারে, ভেবে তিনি প্রায় শিউরে উঠেছেন। যে কোনও মূল্যে হিন্দু-বিরোধী, মুসলিম-বিরোধী, শিখ-বিরোধী, এমনকি খ্রিস্টধর্মের অনুসারী বিভিন্ন জনসমাজ-বিরোধী যে স্লোগান এবং কর্মকাণ্ড আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে ক্রমশই প্রকাণ্ড হয়ে উঠছে, সে সব এখনই বন্ধ করার আর্জি জানিয়েছেন তিনি। যে ভাবে মানুষ এখন রাস্তা দিয়ে হাঁটতেই ভয় পান, এমন পরিস্থিতি আমেরিকা আগে কখনও দেখেছে বলেই মনে হয় না— তাঁর মন্তব্য। ‘দি আইডিয়া অব আমেরিকা’র মূল ভিতটিই ছিল সকল দেশের সকল ধর্মের সকল পরিচিতির মানুষের হাত মিলিয়ে থাকা। সে ভিতে কী করে এত গভীর ধস নামল— তীব্র আক্ষেপ ঝরে পড়েছে তাঁর কথায়।
সম্প্রতি বহু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনেতাই বহু প্রসঙ্গে অগণতন্ত্র ও অমানবিকতার এই প্রাবল্যের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন। তাঁদের সবার কথা সব সময়ে শোনার মতো আন্তরিক হয় না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বলেছেন, গণতান্ত্রিক দেশের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ মেনে চলার আদর্শ কত জরুরি। কিন্তু এই কথা বলার পর পরই তাঁর সামনেই যখন একের পর এক বিদ্বেষমূলক কাণ্ড ঘটে গিয়েছে, তিনি প্রকাশ্য মন্তব্য করার সৌজন্যও দেখাননি, বিদ্বেষ আটকানো তো দূরে থাকুক। সে দিক থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মন্তব্য অনেক মূল্যবান— কেননা শার্লটসভিল-এর বিদ্বেষবর্ষণকারী মিছিল বেরোনোর পর পরই তিনি এই বক্তব্য সর্বসমক্ষে পেশ করেছেন, এবং দলমতনির্বিশেষে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আর্জি জানিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দেশ এখন অসহিষ্ণুতার যে দৃষ্টান্ত দেখাচ্ছে— কৃষ্ণাঙ্গ কিংবা অভিবাসীদের উপর যে নিয়মিত ভাবে আক্রমণ ঘটছে, তাতে তাঁর এই আবেদনে কোনও ফল হবে, এমনটা ভাবা কঠিন। কিন্তু ফল যা-ই হোক, এই কাজটি অত্যন্ত গুরুতর, এবং আমেরিকার শীর্ষনেতার কাছ থেকে ঠিক এই অবস্থানটিই প্রত্যাশিত। গণতান্ত্রিক দেশের নেতারাও যদি এই ভাবে সাধারণ মানুষের কাছে বারংবার তাঁদের বার্তা পৌঁছে দেন, তা হলে সমাজের অন্তত একাংশের মনের মধ্যে বার্তার গুরুত্ব পৌঁছতেও পারে। এটাই এখন একমাত্র আশা। মানুষকে বোঝানো যে পাশের মানুষটিকে না ভালবাসতে পারলেও অন্তত মানুষ হিসাবে সম্মানটুকু দেওয়া। সর্বস্তরের নেতাদের মনে রাখতে হবে, ভবিষ্যৎ বিশ্বদুনিয়ার কাছে তাঁদের এই একটি গভীর দায় আছে— এর থেকে বিচ্যুত হওয়ার দামটি পড়বে অতীব ভয়ঙ্কর।