—ফাইল চিত্র।
শারদোৎসবের আবহে মেতেছে শহর। আর যে কোনও মাতনেই যেমন হয়ে থাকে, এক দিকের মাতামাতি তৈরি করে অন্য দিকের সমস্যা ও সঙ্কট। পুজোপার্বণের সঙ্গে এ শহরের যানজটের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চিরকালই জানা। তবে এ বছর তা মাত্রাছাড়া। লক্ষণীয়, এ বছর পিতৃপক্ষ শেষ হওয়ার আগেই শহরের নানা পুজোমণ্ডপের উদ্বোধন হয়ে গিয়েছে। ফলে অন্য বছরের তুলনায় কিছু আগে থেকেই দুর্ভোগ বেড়েছে জনসাধারণের। এমনিতেই এই ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরীতে বিকল্প পথের পরিমাণ বেশি নয়, তাই কোনও বড় রাস্তা স্তব্ধ হয়ে পড়লে তার প্রভাব অন্যান্য সংযোগকারী রাস্তাগুলির উপরেও পড়তে বাধ্য। এতে বিশেষ ভাবে নাকাল হতে হয় অসুস্থ মানুষদের। কারও কোনও শারীরিক সঙ্কট তৈরি হলে সেই সঙ্কটের নিরসন দুরূহ, প্রায় অসম্ভব দাঁড়িয়ে যায়। কল্পনা করতে অসুবিধা হয় না, ভিআইপি রোড সংলগ্ন ঘন জনবসতি অঞ্চলে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে, কিংবা কোনও বয়স্ক মানুষের ত্বরিত কোনও চিকিৎসা প্রয়োজন হলে পুজোর কয়েকটি দিন কত ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে। প্রতি বছরই পুজোয় শহরের রাস্তায় একই ছবি, এ বার সেই ছবি ভয়ালতর। তাই প্রশাসন ‘কেন আগে থেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা করে না’— এই প্রশ্ন আর যথেষ্ট নয়, প্রশাসন কেন এই সঙ্কটকে বাড়ানোর কান্ডারিদের অবাধ প্রশ্রয় দেয়, এবং নাগরিকের জীবন সচেতন ভাবে দুর্বিষহ-তর করে— প্রশ্ন আসলে এটাই।
কেবল যানজটই তো নয়। এই দিনগুলিতে রাজ্য তথা শহরের স্বাস্থ্য পরিষেবার চিত্রটিও বিশেষ ভাবে করুণ। অধিকাংশ হাসপাতালেই চিকিৎসক ও অন্য কর্মীদের সংখ্যা থাকে অপ্রতুল। অধিকাংশ সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র ধুঁকছে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে। ‘পুজোর ছুটি’ এলে তো কথাই নেই। বিষয়টি আরও প্রকট ভাবে পরিলক্ষিত হয় রক্তের চাহিদার ক্ষেত্রে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত রোগী, প্রসব-জটিলতা, অস্ত্রোপচার বা থ্যালাসেমিয়া-র মতো রক্তের অসুখে ভোগা রোগীদের ক্ষেত্রে যে কোনও মুহূর্তে প্রয়োজন পড়তে পারে রক্তের। ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত সরবরাহ একটি আপৎকালীন পরিষেবা হওয়ায় সেখানকার ব্যবস্থাপনা সর্বদা ঠিকঠাক থাকা প্রয়োজন। অথচ অধিকাংশ ব্লাড ব্যাঙ্কে উৎসবের দিনে রক্তের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকে না। সরকারি ব্লাড ব্যাঙ্কের এ-হেন রক্তের আকালের ফলেই অসহায় রোগীর পরিবারকে পড়তে হয় অবৈধ রক্তবিক্রেতাদের খপ্পরে। পুজোর আনন্দপ্রবাহ এই কারণেও ‘বিপজ্জনক সীমা’র উপর দিয়ে বইতে থাকে।
নাগরিক পরিষেবা কিন্তু সরকার বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দয়া নয়, নাগরিকের অধিকার। এই অধিকারের মধ্যে পড়ে ‘প্রায়রিটি কেয়ার’, অর্থাৎ অগ্রাধিকার অনুযায়ী সেবার ব্যবস্থা। উৎসবের দিনেও এর অন্যথা হওয়ার কথা নয়। মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করা, ব্লাড ব্যাঙ্কে পর্যাপ্ত রক্তের জোগান রাখা, হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসক-কর্মীর পর্যাপ্ত উপস্থিতি বিষয়ে নজরদারির দায় প্রথমত ও প্রধানত প্রশাসনের। তবে যাঁরা সচেতন ও সুপরিকল্পিত ভাবে প্রশাসনের কাজে বাধা তৈরি করে অন্যান্য নাগরিকের জীবনযাপনকে কঠিন সংগ্রাম করে তোলেন, তাঁদের দায়ও একচুল কম নয়। উদ্যাপনকে উৎপীড়ন করে তুলছেন দুই পক্ষ মিলেই।