ফাইল চিত্র।
ঝড় যাঁহাদের বাসস্থান কাড়িয়া লইয়াছে, যাঁহাদের অন্নের সংস্থান রাখে নাই, এমনকি তৃষ্ণার জলটুকুও যাঁহাদের নিকট দুর্লভ— তাঁহারা মূলত, প্রথমত এবং মুখ্যত কোন রাষ্ট্রের নাগরিক? পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা বা ঝাড়খণ্ডের ন্যায় অঙ্গরাজ্যের; না কি ভারত নামক বৃহত্তর সত্তাটির নাগরিকত্বই তাঁহাদের প্রথম পরিচিতি? ঝড়ের পর ত্রাণ এবং ক্ষতিপূরণের টাকা লইয়া কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যে যে টানাপড়েন চলিতেছে, তাহাতে এই প্রশ্নটি অনিবার্য হইয়া উঠে। পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক সীমানার কোনও বাসিন্দা কি একই সময়ে ভারতেরও নাগরিক নহেন? রাজ্যের উপর তাঁহার যে অধিকার, কেন্দ্রের উপর তাঁহার অধিকার কি সেই তুলনায় কোনও অর্থেই ন্যূন হইতে পারে? যদি তাহা না হয়— ভারতীয় রাষ্ট্র যদি তাহার সকল নাগরিকের প্রতি সমান দায়বদ্ধ হয়— তবে, ত্রাণের অর্থসংস্থান লইয়া কোনও তর্ক, কোনও চাপানউতোর থাকিতেই পারে না। নাগরিকের অধিকাররক্ষার দায়িত্ব কেন্দ্র ও রাজ্য কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া বহন করিবে। কেন্দ্রের হাতেই যে হেতু টাকার অধিকতর সংস্থান, ফলে রাজ্যের পরামর্শ মানিয়া কেন্দ্র ত্রাণের টাকার ব্যবস্থা করিবে। নাগরিকের প্রতি কর্তব্য সম্পাদনে কোনও কিছুকেই বাধা হইতে দেওয়া চলিবে না— এই কথাটি স্বীকার করিয়া লইবে রাজ্য ও কেন্দ্র, উভয় তরফই।
বাস্তব দৃশ্যত ভিন্ন। ইয়াস ঝড়ের পর মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ ও ক্ষতিপূরণ বাবদ যত টাকা দাবি করিয়াছেন, এবং কেন্দ্রীয় সরকার যে টাকা বরাদ্দ করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে কোনও সামঞ্জস্য খুঁজিবার চেষ্টাও অর্থহীন। কেহ বলিবেন, ইহার পিছনে রাজনীতি আছে— বিরোধী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্য হইতে পারে, এমন কিছু করিতে নরেন্দ্র মোদীরা নারাজ। কেহ বলিবেন, আসল কথা অবিশ্বাস— মুখ্যমন্ত্রী যে ভঙ্গিতে ক্ষতির খতিয়ান পেশ করেন, তাহা বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ যাহাই হউক, তাহাতে রাজ্যবাসীর স্বার্থ রক্ষিত হইতেছে না। প্রসঙ্গত, গত বৎসরের আমপান ঝড়ের পরও কেন্দ্রীয় ক্ষতিপূরণ অপ্রতুল ছিল। প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টার সফর সারিয়া এক হাজার কোটি টাকা ত্রাণ দিয়া গিয়াছিলেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দিয়াছিল আরও ২৭০০ কোটি টাকা। আমপানের ক্ষতির তুলনায় যৎসামান্য। এবং, ভোট-প্রচারে আসিয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করিয়াছিলেন যে, রাজ্যকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৫,০০০ কোটি টাকা দেওয়া হইয়াছে। কী ভাবে, সেই প্রমাণ অবশ্য তিনি দেন নাই। এই অভিজ্ঞতা হইতে আশঙ্কা হয়, ইয়াস-এর ত্রাণও হয়তো কথার জালে আটকাইয়া থাকিবে, হয়তো মিথ্যা প্রতিশ্রুতির উজান ঠেলিয়া তাহা মানুষের নিকট পৌঁছাইতে পারিবে না।
ত্রাণের দাবি প্রসঙ্গে নাগরিক পরিসরে দুইটি কথা ঘুরিতেছে। এক, ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী যেখানে কোভিড পরিস্থিতির কথা ভাবিয়া কেন্দ্রের নিকট কিছুই দাবি করেন নাই, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের দাবি অসঙ্গত। এবং দুই, পশ্চিমবঙ্গকে ত্রাণের টাকা দিয়া লাভ নাই, কারণ তাহা দুর্নীতিতে মার যাইবে। প্রথম কথাটি সম্পূর্ণ অর্থহীন— কেন্দ্রীয় তহবিলে যে টাকা আছে, তাহাও মানুষেরই টাকা; ফলে, তাহা কোভিড মোকাবিলায় খরচ করা যেমন সঙ্গত, ঝড়ের ত্রাণে খরচ করাও ততখানিই সঙ্গত। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী আপন বিবেচনা অনুসারে কাজ করিয়াছেন, করিতেই পারেন। কিন্তু তাঁহাকেই আদর্শ মানিতে হইবে কেন? দ্বিতীয় কথাটিকে এত সহজে উড়াইয়া দিবার উপায় নাই। পশ্চিমবঙ্গে ত্রাণে দুর্নীতির অভিযোগ প্রকট। তাহার তদন্ত করিতে সরকারকে বাধ্য করা যাইতে পারে, এই বারের ত্রাণপ্রক্রিয়া যাহাতে দুর্নীতিহীন হয়, সেই দাবি করা যাইতে পারে। বস্তুত, এই বার মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাপনায় দলকে বাহিরেই রাখিয়াছেন— নির্ভর করিতেছেন প্রশাসনের উপর। কিন্তু কোনও অজুহাতেই রাজ্যবাসীকে— দেশবাসীকে— তাঁহাদের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা চলে না।