—ফাইল চিত্র।
এই শহরের এক আমোদপ্রিয় লেখক তথা শিল্পী মাঝে মাঝে তাঁর বন্ধুদের বলতেন, “অনেক দিন সব কেমন চুপচাপ, একটু উত্তেজনা করা যায় না?” চার দশক আগে তিনি বিদায় নিয়েছেন। আজ তিনি এমন কথা ভাবারও অবকাশ পেতেন না, কারণ পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের কল্যাণে এই শহরে তথা রাজ্যে এখন নিত্যনতুন উত্তেজনার কোনও বিরাম নেই। গত সপ্তাহে মহানগরীর মানুষ তেমনই এক কুনাট্যের সাক্ষী থাকলেন। সপ্তাহের শুরুতেই মুখ্যমন্ত্রী সহসা প্রবল স্বরে ঘোষণা করেছিলেন, শহর জুড়ে বিশৃঙ্খলা আর বরদাস্ত করা হবে না, বেআইনি বহুতল, অনুমোদনহীন বিদ্যুৎ সংযোগ ইত্যাদি অনাচার বন্ধ করতে হবে, এবং রাস্তায় রাস্তায় হকারদের যথেচ্ছ বেসাতি চলবে না। অতঃপর সপ্তাহের প্রথমার্ধে কয়েক দিন ইতস্তত জনপরিসর থেকে অবৈধ হকার ও অন্য দখলদারদের অপসারণের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল, নাগরিকরা ভাবতে শুরু করেছিলেন বুঝি বা এই শহরের পথঘাট আবার, অন্তত অংশত, হাঁটাচলার উপযোগী হবে। কিন্তু নিশি না পোহাতেই কাণ্ডজ্ঞানহীন পুলিশ একেবারে বুলডোজ়ার নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ল। (না কি সেই অভিযানটিও কুনাট্য-রঙ্গেরই অঙ্গ?) তার অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় নানা দিক থেকে ‘উচ্ছেদ চলবে না’ রব উঠল, উত্তেজনার পারদ চড়ল, এবং তেরাত্তির পার হতে না হতেই মুখ্যমন্ত্রী আবার একই রকম প্রবল স্বরে ঘোষণা করলেন, তিনি ‘এমন ভাবে’ হকার উচ্ছেদ করতে বলেননি, পুরো কাজটি সুষ্ঠু ভাবে সম্পাদন করতে হবে। সেই মহৎ ব্রত পালনের জন্য আপাতত তিনি পুরসভা, পুলিশ ইত্যাদিকে এক মাস সময় দিয়েছেন। অর্থাৎ, শহরের রাস্তা বেদখলের প্রাচীন সমস্যা যেখানে ছিল সেখানেই ফিরে গেল, হাতে রইল কয়েক দিনের ধুন্ধুমার উত্তেজনার দৃশ্যাবলি। অতঃপর? আপনবেগে পাগলপারা এই রাজ্যে এক মাস অতি দীর্ঘ সময়, তার মধ্যে নিশ্চয়ই অলীক কুনাট্য-রঙ্গের আরও অনেক উপলক্ষ খুঁজে পাওয়া অথবা তৈরি করে নেওয়া যাবে।
বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের সমালোচকরা বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর চিত্রনাট্যটি দুর্বল, হাস্যকর, কাঁচা। এই সমালোচনাকে অযৌক্তিক বলার উপায় মুখ্যমন্ত্রী নিজেই রাখেননি। কেবল যত্রতত্র হকারের ক্রমবর্ধমান দখলদারি নয়, আরও সহস্র ভাবে রাস্তা এবং ফুটপাত বেদখল করে রাখার সমস্যাটি এই শহরে এত পরিব্যাপ্ত এবং এতটাই প্রাচীন যে, তা নিয়ে ‘হঠাৎ’ শোরগোল তোলার কোনও অর্থই নেই। এই অনাচার শুধু পুরসভা ও পুলিশের চোখের সামনে চলে আসছে না, তাদের সম্পূর্ণ ‘সহযোগিতা’ ছাড়া এ জিনিস চলা যে সম্ভব নয় সেই সত্যটিও যে কোনও নাগরিক বিলক্ষণ জানেন। গোটা অব্যবস্থাটির সঙ্গে এক দিকে দলীয় রাজনীতির স্বার্থ এবং অন্য দিকে সহস্রধারায় সঞ্চালিত কাঞ্চনরঙ্গের নিবিড় সংযোগটিও সর্বজনবিদিত এবং বহুচর্চিত বাস্তব। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও সে কথা কার্যত স্বীকার করেছেন। এক বার নয়, বার বার।
প্রশ্ন হল, এমন সর্বব্যাপী অনাচারে রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক এবং শাসক দলের সর্বময়ী কর্ত্রী যদি এতই ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত, তখন কঠোর ভাবে তার প্রতিকারে উদ্যোগী হননি কেন? কে তাঁকে বারণ করেছে? ২০১৮ সালে হকার নিয়ন্ত্রণ আইন চালু হয়েছিল, বিভিন্ন পুরসভা এলাকায় হকারদের বসার সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা করার জন্য কমিটি তৈরি হয়েছিল। তার পরে ছ’বছর অতিক্রান্ত, এখন মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্ন করছেন: সব ব্যবস্থা তৈরি করতে ‘আর কত সময় লাগবে?’ এই প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়ার দায় এবং দায়িত্ব তো তাঁরই। সেই দায় স্বীকার করলে অবশ্য তাঁকে কুনাট্যের আশ্রয় ছেড়ে যথার্থ প্রশাসক হয়ে উঠতে হবে। দল এবং প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে ওঠা বিপুল আবর্জনা সাফ করতে হবে। সে অতি কঠিন কাজ। অনেক সহজ হল থেকে থেকে হুঙ্কার দেওয়া, শোরগোল তোলা, লাফঝাঁপ করা এবং তার পরেতে হঠাৎ বেঁকে ডাইনে মোচড় মেরে বাঁয়ের দিকে তিনটে গলি ছেড়ে আবার আমড়াতলার মোড়ে এসে পড়া।