ফাইল চিত্র।
পরিচিত চাণক্যশ্লোকটিকে সম্প্রসারিত করিয়া বলিতে হয়, কেবল উৎসবে-ব্যসনে-দুর্ভিক্ষে নহে, অক্সিজেন, ঔষধ ও হাসপাতালের অভাবজনিত সঙ্কটে যিনি পার্শ্বে থাকেন, তিনিই প্রকৃত বান্ধব। সরকার যখন নীতিপঙ্গুতায় আচ্ছন্ন, দেশ জুড়িয়া শ্মশানের হাহাকার, পোড়া বঙ্গভূমে বিপন্ন মানুষকে ভরসা দিবার আপ্রাণ চেষ্টা করিতেছেন নাগরিকদের একাংশ, বিশেষত তরুণতরুণীরা। কোন হাসপাতালে কত শয্যা খালি, কোথায় অক্সিজেন বা ঔষধ আছে, সেই তথ্য সংগ্রহ করিয়া তাঁহারা সমাজমাধ্যমে জানাইতেছেন। প্রয়োজনে বেপাড়ার বন্ধুকে ‘ট্যাগ’ করিতেছেন। এই ভাবে দমদম গড়িয়ায় ঔষধ খুঁজিয়া পাইতেছে, রামরাজাতলার জন্য যাদবপুরে দুর্লভ অক্সিজেন মিলিতেছে। কেহ জানাইতেছেন, তিনি কোভিড-আক্রান্তদের জন্য রান্না করিতেছেন, ঠিকানা দিলে বাড়ি পৌঁছাইয়া দিবেন। অপরিচিত গাড়িচালক বলিতেছেন, প্রয়োজনে তাঁহার গাড়ি অসুস্থদের হাসপাতালে লইয়া যাইবে। কেহ অক্সিজেনের জন্য পরীক্ষাগারের সিলিন্ডার চাহিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে আবেদন করিতেছেন। অতিমারি দেখাইতেছে, ‘মানুষের জন্য কাজ করিতে চাওয়া’ নেতারা অনেকেই বিপদ বুঝিয়া অন্তর্হিত হইলেও প্রকৃত স্বেচ্ছাসেবীরা থাকিয়া যান। ভোটভিক্ষুক, ক্ষমতালিপ্সু নেতাদের আধমরা চৈতন্যকে এই ভাবে ঘা মারিয়া তাঁহারা বাঁচাইয়া তুলিতে পারিবেন কি না, তাহা অবশ্য ভবিষ্যতের বিচার্য।
সঙ্কটের চরম পর্ব শেষ হইলেই কি তারুণ্যের এই উদ্যোগের অবসান হইবে? না কি, নেতানেত্রীশাসিত এই রাজ্যের জড়ভূমিতে তাহা লইয়া আসিবে রাজনীতির নূতন ভাষা? তরুণ প্রজন্মের ঐকান্তিক তৎপরতা আশা জাগায়। মনে রাখা দরকার, ইউরোপের ন্যায় পার্লামেন্ট, প্রতিনিধিত্ব, ক্রমওয়েল, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার ঘোষণা ইত্যাদি হইতে ভারতীয় গণতন্ত্র জন্মায় নাই। পরাধীন দেশে ১৮৮৭ সনে দুই বৎসরের একটি শিশু সঙ্ঘ বার্তা পাঠাইয়া ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন, চেম্বার অব কমার্স, সানবিম লাইব্রেরি, আর্য সমাজ, মহমেডান অ্যাসোসিয়েশন হইতে প্রতিনিধি জোগাড় করিয়াছিল। দুই বৎসর পরে সাড়ে বত্রিশ ভাজা সংস্থাটির প্রস্তাব: প্রতিনিধিদের প্রকাশ্য সমাবেশে, কোনও রাজনৈতিক সঙ্ঘ হইতে নির্বাচিত হইতে হইবে। জাতীয় কংগ্রেসের প্রাথমিক প্রসার ঘটে এই ভাবেই। টিলক ও গাঁধী পরের কথা। সমাজমাধ্যমের জন্মের ঢের আগে এই দেশে জনস্তরে বিভিন্ন উদ্যোগ রাজনীতির দিশা নির্দেশ করিয়াছিল। আজ কি তাহার পুনরুজ্জীবন সম্ভব?
গণমাধ্যম ও জনসংস্কৃতির এই যুগে সেই রাজনীতি অবশ্যই অন্য রকম হইবে। আধুনিক এক ফরাসি দার্শনিক বলিয়াছিলেন, রাজনীতি এক বিরল মুহূর্ত। সেই মুহূর্তে বিভিন্ন দিক হইতে অসম অবস্থানে থাকা নানা ব্যক্তি ও সমষ্টি সমতাভিত্তিক কার্যকলাপ করে, ক্ষমতার নির্দিষ্ট ক্রম বদলাইয়া যায়। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব হইতে এই দেশে গাঁধী এবং কমিউনিস্ট দলের সফল আন্দোলনে বারংবার বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ভাবে অসমদের এই সমতাভিত্তিক কার্য দেখা গিয়াছে। সমাজমাধ্যমেও অক্সিজেন, অ্যাম্বুল্যান্স, ওষুধের অভাব লইয়া সেই রকম সন্ধিক্ষণ সৃষ্টি হইয়াছে। তাৎক্ষণিক এই মুহূর্ত বিফলে যাইবে, না আরও বড় রাজনৈতিক অভিঘাত লইয়া ফিরিয়া আসিবে, তাহা সমাজ ও রাজনীতির টানাপড়েনের মধ্য দিয়াই স্থির হইতে পারে।