Bengal SSC Recruitment Case

প্রতারণার কবলে

ই অকল্পনীয় পরিস্থিতিতে প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল করার নির্দেশ আপাতত স্থগিত হয়েছে, কিন্তু মূল সমস্যার কিছুমাত্র সুরাহা হয়নি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২৪ ০৭:১৫
Share:

—ফাইল চিত্র।

সমালোচনা, নিন্দা, ভর্ৎসনা, তিরস্কার ইত্যাদি শব্দগুলি পশ্চিমবঙ্গের শাসককুলের কাছে সম্ভবত সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়ে গিয়েছে। সুতরাং সুপ্রিম কোর্ট সরকার পোষিত স্কুলে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ সংক্রান্ত মামলায় যে কঠোর ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রাজ্যের শিক্ষা প্রশাসনকে তিরস্কার করেছে, ‘সিস্টেমিক ফ্রড’ বা সামগ্রিক কাঠামোগত প্রতারণার মতো শব্দবন্ধ প্রয়োগ করেছে, তার পরেও শাসকরা নিশ্চয়ই মাথা উঁচু করে বড় বড় কথা বলবেন এবং নতুন উদ্যমে আইনি প্যাঁচপয়জার কষতে তৎপর হবেন। অথচ, সর্বোচ্চ আদালতের মহামান্য বিচারপতিরা আরও এক বার স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, অব্যবস্থা এবং অপদার্থতা কোন শিখরে পৌঁছলে শিক্ষক নিয়োগের জন্য গৃহীত পরীক্ষার ফল সংক্রান্ত প্রাথমিক হিসাবপত্রও উধাও হয়ে যেতে পারে এবং তার ফলে নিযুক্ত শিক্ষকদের কে যোগ্য কে নয় তা নির্ধারণ করা ‘অসম্ভব’ হতে পারে। এই অকল্পনীয় পরিস্থিতিতে প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল করার নির্দেশ আপাতত স্থগিত হয়েছে, কিন্তু মূল সমস্যার কিছুমাত্র সুরাহা হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশের পরেও ‘হারানো’ নথি উদ্ধার হবে কি না, যোগ্যাযোগ্য নির্ধারণের কঠিন, জটিল এবং রহস্যময় গোলকধাঁধা পার হয়ে বাতিল শিক্ষকদের কত জনের কী পরিণতি দাঁড়াবে, আরও কত বাতিল-তালিকা তৈরি হবে, ২০১৬ সালে যে মামলা-পর্বের শুরু, আরও কত বছর পরে কোথায় গিয়ে তার সমাপ্তি ঘটবে, কোনও দিন সমাপ্তি ঘটবে কি না, ঘটলেও সমাপ্তি এবং নিষ্পত্তির মধ্যে কতটা দূরত্ব থেকে যাবে— দেবা ন জানন্তি।

Advertisement

কিন্তু বড় ছবিটি এখন সম্পূর্ণ নিরাবরণ। সেই ছবি, আক্ষরিক অর্থেই, সর্বনাশের। শিক্ষার সর্বনাশ। নিছক পরিসংখ্যানের মাপকাঠিতে তার যথার্থ পরিমাপ হয় না, হতে পারে না। যাঁদের চাকরি বাতিল হয়েছে বা হতে পারে তাঁদের সংখ্যা গোটা রাজ্যের সরকারি তথা সরকার পোষিত স্কুলের প্রায় পাঁচ লক্ষ শিক্ষকের অনুপাতে যত কমই হোক, মূল প্রশ্ন সংখ্যার নয়, আস্থার, সুস্থিতির, পরিবেশের। পশ্চিমবঙ্গে সামগ্রিক ভাবেই শিক্ষার পরিবেশ বিপন্ন। আজ নয়, বহু দিন ধরেই শিক্ষা সংক্রান্ত নানা সমীক্ষায় সেই বিপদের বিস্তর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। অতিমারির দু’বছরে সংক্রমণের স্বাভাবিক আশঙ্কা এবং রাজ্য সরকারের অস্বাভাবিক অপদার্থতা ও নির্বোধ ঔদাসীন্য সেই সঙ্কটকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। এই বিপর্যয়ের পরে দ্বিগুণ উদ্যমে ক্ষতিপূরণের সার্বিক অভিযান ছিল প্রত্যাশিত এবং জরুরি। তার চিহ্নমাত্র সরকারি কর্তাদের আচরণে দেখা যায়নি। স্কুলশিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ মলিন থেকে মলিনতর হয়ে চলেছে। এবং সেই প্রেক্ষাপটেই এক প্রগাঢ় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির অকূলপাথার এবং তার অভিঘাতে চাকরি বাতিল হওয়ার ঘটনাপরম্পরা।

রাজ্যের প্রশাসকদের কাছে শুভবুদ্ধি বা আত্মশুদ্ধির প্রত্যাশা করে কোনও লাভ নেই, সুতরাং এই অতলস্পর্শী অন্ধকার থেকে রাজ্যের স্কুলশিক্ষাকে রক্ষা করার দায় ও দায়িত্ব এসে পড়ে নাগরিক সমাজের উপরে, বিশেষত শিক্ষকশিক্ষিকাদের উপরেই। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা স্বাভাবিক দায়িত্ববোধ ও ছাত্রদরদের প্রেরণায় তাঁদের কর্তব্য পালন করে চলেছেন বলেই স্কুলশিক্ষার কাঠামো এখনও দাঁড়িয়ে আছে, রাজনীতি এবং দুর্নীতির যৌথ আক্রমণও তাকে পুরোপুরি ভাঙতে পারেনি। কিন্তু সেই স্বাভাবিক দায়িত্বের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে অস্বাভাবিক দায়— ভক্ষকরূপী রক্ষকদের হাত থেকে শিক্ষাকে বাঁচানোর দায়। সুপ্রিম কোর্ট যোগ্য-অযোগ্য নিরূপণের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে— এই সংবাদ অবশ্যই আশা জাগায়। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যেন সর্বনাশের শিকার না হয়, তা দেখার দায় কেবল আদালতের উপর ছেড়ে দিলে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকরা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অমার্জনীয় অপরাধে অপরাধী হয়ে থাকবেন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement