Opposition Alliance

পশ্চিমবঙ্গ ও ইন্ডিয়া

খেলার স্বরূপটি সুস্পষ্ট। এক দিকে, রাজ্যের রাজনীতিতে কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের পারস্পরিক সম্পর্ক বিপ্রতীপ, তাদের সহাবস্থান বা সমবায় কার্যত অ-সম্ভব।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৫১
Share:

—ফাইল চিত্র।

গল্পে আছে, এক জমিদার নায়েবের উপর রাগ করে তাঁকে বলেছিলেন, “তোমাকে বরখাস্ত করলাম।” নায়েব শান্ত ভাবে জবাব দিয়েছিলেন, “আমি বরখাস্ত হলাম না।” পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি কংগ্রেসের আচরণ দেখে গল্পটি মনে পড়তে পারে। তৃণমূলের পশ্চিমবঙ্গে একলা চলার সিদ্ধান্তটি অপ্রত্যাশিত ছিল না। এই ঘোষণার পরে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী পরিসরে ‘ইন্ডিয়া’ নামক মঞ্চটির কার্যকর কোনও প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। কিন্তু সেই সত্যটিকে সাফ সাফ স্বীকার করে নিতে কংগ্রেসের বাধছে, বিশেষত রাজ্যে ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা চলার সময়ে। দলের মুখপাত্র জয়রাম রমেশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ইন্ডিয়া-র গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বলে অভিহিত করেছেন। রাহুল গান্ধী তাঁর ন্যায় যাত্রার ভাষণে এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি, বরং বাঙালিকে বিজেপির প্রতিপক্ষ হিসাবে জেগে উঠতে বলে পরোক্ষ ভাবে রাজ্যের জননেত্রীকে বিরোধী রাজনীতিতে প্রতিস্পর্ধী ভূমিকা নিতে বলেছেন। চলতি ভাষায় বললে— খেলা চলছে।

Advertisement

খেলার স্বরূপটি সুস্পষ্ট। এক দিকে, রাজ্যের রাজনীতিতে কংগ্রেস এবং তৃণমূল কংগ্রেসের পারস্পরিক সম্পর্ক বিপ্রতীপ, তাদের সহাবস্থান বা সমবায় কার্যত অ-সম্ভব। ‘বিজেপিকে প্রতিহত করা’র প্রয়োজন সেই বাস্তবকে অতিক্রম করে যাবে, এমন কোনও বৃহত্তর প্রেক্ষাপট আদৌ তৈরি হয়নি, হওয়ার কোনও লক্ষণও নেই। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে ইন্ডিয়া মঞ্চে এবং রাজ্য রাজনীতিতে কংগ্রেসের জোটসঙ্গী হিসাবে বামপন্থীদের উপস্থিতি এই জটিল বাস্তবকে জটিলতর করেছে। সুতরাং, মুখ্যমন্ত্রীর ‘একলা চলব রে’ অবস্থান প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু অন্য দিকে, কংগ্রেসের পক্ষে এই অবস্থানকে এবং তার পশ্চাদ্‌বর্তী বঙ্গীয় বাস্তবতাকে স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করে নেওয়াও কঠিন, কারণ তা হলে বিরোধী ঐক্যের মঞ্চ থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রকারান্তরে বিদায় জানাতে হয়। মঞ্চটি ইতিমধ্যেই নড়বড়ে, পঞ্জাব থেকে বিহার অবধি নানা ঘটনাপরম্পরার মধ্য দিয়ে ক্রমশ তার ভঙ্গুরতা বেড়ে চলেছে, এই সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দলকে ধরে রাখতে না পারলে কেবল ইন্ডিয়া-র অস্তিত্বই বিপন্ন হবে না, বিরোধী রাজনীতিতে কংগ্রেসের দ্রুতহ্রাসমাণ গুরুত্ব আরও কমবে। রাহুল গান্ধী অতএব ধরি মাছ না ছুঁই পানি নীতি অনুসরণ করে পশ্চিমবঙ্গে ন্যায় যাত্রার পালা সেরে ফেলতে চেয়েছেন।

প্রথম থেকেই পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দিলে কংগ্রেসের নেতাদের আজ এমন উভয়সঙ্কটে পড়তে হত না। সীমিত কিছু এলাকা বাদ দিলে এই রাজ্যে কংগ্রেসকে হীনবল বললেও বেশি বলা হয়। এমন পরিস্থিতিতে দলের কোনও কোনও রাজ্য নেতার নিজস্ব প্রতিপত্তি বা অহঙ্কারকে প্রশ্রয় দিলে তা আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য। বস্তুত, কেবল পশ্চিমবঙ্গ নয়, বিভিন্ন রাজ্যেই বাস্তব পরিস্থিতিকে কংগ্রেস নেতৃত্ব যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি, তার মাসুলও গুনে চলেছেন। নিজের প্রকৃত ওজন না বুঝে রাজনীতির খেলা খেলতে যাওয়ার এই ঐতিহ্যই এই রাজ্যেও প্রকট। বিরোধী ঐক্যের স্বার্থে, গণতান্ত্রিক প্রতিস্পর্ধা গড়ে তোলার স্বার্থে বাস্তববাদী নীতি অনুসরণ করা তাঁদের অবশ্যকর্তব্য। আবার, সেই উদ্দেশ্য সাধনে কংগ্রেসকে উৎসাহ দেওয়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীরও কর্তব্য। ন্যায় যাত্রাপথে রাহুল গান্ধী পশ্চিমবঙ্গে উপস্থিত হওয়ার পর যে এতখানি বাধার সম্মুখীন হতে হল, সেটা যথেষ্ট দুর্ভাগ্যজনক। আপন স্বার্থ দেখার অধিকার নিশ্চয়ই তাঁর আছে, কিন্তু সে জন্য কোনও ক্ষুদ্র বা সঙ্কীর্ণ অসূয়ার বশবর্তী হয়ে কংগ্রেসের পথে অহেতুক বাধা সৃষ্টি করার কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই। কোনও বৃহৎ আদর্শ বা লক্ষ্য নয়, বরং কংগ্রেসকেই আক্রমণের লক্ষ্য করে নিজস্ব স্বার্থকে প্রকট করে তোলার উদ্দেশ্য কী, তা নিয়ে জনমানসে সন্দেহ জাগে বইকি। ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য এখন বিরোধী ঐক্যের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বাস্তব যেন সেই ঐক্যের পথের কাঁটা হয়ে না দাঁড়ায়।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement