Indian Judiciary

বিপদের দিকে

সংবিধানেই আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগকে বিরাট ক্ষমতা দেওয়া আছে। আবার পাশাপাশি তার সঙ্গে সেই ক্ষমতার একটি সীমাও নির্ধারিত করে দেওয়া আছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:২০
Share:

সুপ্রিম কোর্ট। ফাইল ছবি।

এও এক যুদ্ধ, বললে অত্যুক্তি হবে কি? গত দু’মাস ধরে বিচারবিভাগ বিষয়ে দেশের কেন্দ্রীয় সরকার যে সব কথা বলে আসছে, তাতে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, বিচারবিভাগের উপর শাসনবিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে এগোনোর চেষ্টাটি এই মুহূর্তে অতীব জোরদার। অবশ্য দেশে যে-হেতু এখনও সাংবিধানিক গণতন্ত্র বলবৎ, কাজটা খুব সহজসাধ্য নয়। সুতরাং, একের পর এক মন্তব্য, বক্তব্য, পদক্ষেপণ দিয়ে চাপ জারি রাখার কৌশল নিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। সম্প্রতি বিচারপতি নিয়োগের কলেজিয়াম নিয়ে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়কে চিঠি দেওয়ার পর সরকারি কৌশল একেবারে গ্রীষ্মকালীন রৌদ্রের মতো উজ্জ্বল। মন্ত্রী যত বলেছেন, তার কয়েকগুণ বেশি বলেছেন উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় মশাই। বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি ‘সংসদীয় সার্বভৌমতা’র দিকে মনোযোগ দিতে আহ্বান করেছেন। এর অর্থ, শাসন ও আইন বিভাগের উপর বিচারবিভাগের যে নজরদারিকে এত দিন সাংবিধানিক গণতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষার পদ্ধতি বলে দেখা হয়ে এসেছে— বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সেই জায়গাটিতেই পরিবর্তন আনতে আগ্রহী। বিচারবিভাগের ক্ষমতা ও অধিকারের সীমা ছোট করতে, কিংবা অন্য দিক দিয়ে বললে, বিচারবিভাগের কাজে শাসনবিভাগের নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে আগ্রহী।

Advertisement

সন্দেহ নেই, আপাতত বিচারপতি নিয়োগের কলেজিয়াম ব্যবস্থাটি যে ভাবে চলছে, তাতে সংশোধন দরকার। বিচারবিভাগের উচ্চ পর্যায়ের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ অত্যধিক হয়ে পড়ছে, এই অভিযোগ মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যাঁরা এই ব্যবস্থাকে ‘ব্ল্যাক বক্স’ বলে অভিহিত করে থাকেন, তাঁরা বিচারবিভাগের স্বচ্ছতা, এবং ফলত দায়বদ্ধতার অবাঞ্ছিত হানি নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করছেন, এই দুশ্চিন্তাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করাও আবশ্যক। কিন্তু সংশোধনের অর্থ কি ‘সার্চ অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন কমিটি’-তে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘নমিনি’ বা মনোনীত প্রতিনিধির মাধ্যমে শাসনবিভাগের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা? এতে কি সমস্যার সুরাহা হবে? না কি আরও বড় সমস্যা দেখা দেবে? এমন কোনও ‘সংশোধন’-এ গণতন্ত্রের সামগ্রিক ভারসাম্যটিই বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সুতরাং, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ দেশের বিরোধী নেতারা সঙ্গত ভাবেই বলছেন, এই মুহূর্তে দেশের সরকার বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতাকে বিপন্ন করার চেষ্টায় আছে।

বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতার প্রশ্নটি আসলে গণতন্ত্রকে রক্ষা করারই মৌলিক শর্ত। কলেজিয়াম ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বিচারপতি নিয়োগ, এবং কলেজিয়ামকে ‘স্বাধীন’ রাখার সিদ্ধান্তটি ছিল সাংবিধানিক। সংবিধানেই আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগকে বিরাট ক্ষমতা দেওয়া আছে, আবার পাশাপাশি তার সঙ্গে সেই ক্ষমতার একটি সীমাও নির্ধারিত করে দেওয়া আছে। শাসনবিভাগীয় কার্যধারার গতিরেখাটি শীর্ষ আদালতের মতামত-নিরপেক্ষ যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা আছে। একেই বলা হয় গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা। এই ভারসাম্য নষ্ট হলে, এত বড় দেশের শাসনবিভাগীয় ক্ষমতা এক দিকে বিপুল ভাবে হেলে পড়লে, গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিটিই ভেঙে পড়তে পারে। এইখানেই বর্তমান কলেজিয়াম-বিতর্কের মূল গুরুত্ব। কোনও ‘পলিটিক্যাল এক্সিকিউটিভ’-এর উপর বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে নির্ভর করার প্রস্তাবটি সে ক্ষেত্রে দেশের বিধিব্যবস্থা বা ‘ল অব দ্য ল্যান্ড’ কে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করতে চলেছে। আশা করা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্য বিরোধী রাজনীতিকরা বিষয়টিকে যথাসম্ভব গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন, সঙ্কীর্ণ দলগত বা ব্যক্তিগত স্বার্থের উপরে বিষয়টিকে রাখবেন, এবং নাগরিক মতামত তৈরি করে রাজনৈতিক মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হবেন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement